বাংলাদেশ ব্যাংকের করা ঋণ-আমানতের অনুপাতসীমা (এডিআর) নিয়ে জুনের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা ঋণ দিতে পারে বা বিনিয়োগ করতে পারে। ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর সীমা এক্ষেত্রে ৯২ টাকা পর্যন্ত। অনেক ব্যাংক এ সীমা লঙ্ঘন করে ১০০ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। অর্থাৎ তারা ১০০ টাকার বিপরীতে ১০০ বা তার বেশি টাকা ঋণ দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ঋণ দিয়েছে সর্বোচ্চ ১২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এছাড়া এবি ব্যাংক ৯২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংক ৯০ দশমিক ২৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশ এবং পদ্মা ব্যাংক ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ ঋণ দিয়েছে।
এছাড়া ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইনি সীমার বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১০৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৯৩ দশমিক ২১ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংক ১০১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, এবি ইসলামী ব্যাংক ১০৭ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের শরিয়াহ শাখা বিনিয়োগ করেছে ১২২ দশমিক ৮২ শতাংশ ও ৯৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
সীমা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত
নির্ধারিত ঋণসীমা সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ-আমানত অনুপাতের সীমা (এডিআর) নির্ধারণ করে দেয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এটি মানতে বাধ্য। যদি কোনো ব্যাংক এ সীমা লঙ্ঘন করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক সীমালঙ্ঘন করেছে তাদের ঋণ দেওয়ার সীমা কমিয়ে দ্রুত এডিআর সমন্বয় করা দরকার।
সীমার বাইরে ঋণ দেওয়া মানে আমানতকারী ঝুঁকিতে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, কারণ ব্যাংকগুলো বেশি ঋণ দিলো, কিন্তু তাদের আমানত নেই- এমন অবস্থায় সঠিক সময়ে তারা দায় পরিশোধ করতে পরবে না। যখন দায় পরিশোধে ব্যর্থ হবে তখন ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হবে। এতে মানুষ ব্যাংকে টাকা জমানো কমিয়ে দেবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বিষয়টি ‘দেখছে’ কেন্দ্রীয় ব্যাংক
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এডিআর বেড়ে যাওয়া মানে সবাই বেশি ঋণ দিয়েছে তা নয়। অনেক সময় আমানত ওঠালে ঋণের রেশিও বেড়ে যায়। আবার ব্যাংকের মূলধন আছে, অতিরিক্ত প্রভিশন রাখা আছে, এগুলো ব্যবহার করে। তাই এটা বিশ্লেষণ না করে সরাসরি কিছু বলা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ-আমানতের শৃঙ্খলার জন্য একটা সীমা বেঁধে দিয়েছে, যেন ব্যাংকগুলো এর মধ্যে থাকে। যারা সীমার চেয়ে বেশি ঋণ দেবে তাদের তারল্য সংকট তৈরি হবে। এখন কিছু ব্যাংক এ সীমার বাইরে আছে। তাদের মধ্যে কিছু ব্যাংক আগে থেকেই সমস্যাগ্রস্ত। অনেকের আমানত কমে গেছে। যেসব ব্যাংক এই সমস্যায় আছে তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে (ক্লোজ মনিটরিং) রাখা হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা, ন্যাশনাল, ফাস্ট সিকিউরিটিসহ অনেক ব্যাংকে সমন্বয়ক বসানো আছে। যেখানেই সমস্যা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওই ব্যাংকে সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের কাজ করছেন।
আমানত ও বিনিয়োগে (ঋণ) কার কী অবস্থান
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪২৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৭৮ দশমিক ৫১ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বেশিরভাগ ব্যাংকের এডিআর রেশিও নির্ধারিত সীমার মধ্যেই রয়েছে। যারা আইনি সীমার বাইরে ঋণ বা বিনিয়োগ করেছে তাদের মধ্যে বেসরকারি এবি ব্যাংকের আমানত ৩১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা আর ঋণ ৩০ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ২৯৭ কোটি টাকা আমানত আছে। এর বাইরে তারা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ২৭৩ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আমানত ১৬২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে ৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ব্যাংকটির এডিআর ১২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
নিয়ম অনুযায়ী ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর রেশিও থাকার কথা ছিল ৮৭ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ১২ শতাংশ। ব্যাংকটি ৪১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৪২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। তাদের ইডিএফের ঋণ ৭৯৭ কোটি টাকা।
আইএফআইসি ব্যাংকের আমানত ৪১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ দিয়েছে ৩৮ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তাদের ইডিএফের ঋণ ৯৫৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির এডিআর ৯০ দশমিক ২৯ শতাংশ।
পদ্মা ব্যাংকের এডিআর রেশিও দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ২ শতাংশ। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটিতে গ্রাহকের আমানত রয়েছে ৫ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে ৮২২ কোটি টাকা। এর বিপরীতের তারা ঋণ দিয়েছে ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা।
ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০০ টাকার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯২ টাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকলেও চারটি ব্যাংক এ সীমা লঙ্ঘন করেছে।
এর মধ্যে বেসরকারি ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আমানত ৪৫ হাজার ৯১ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে তিন হাজার ১১২ কোটি টাকা। আর বিনিয়োগ করেছে ৫৩ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইডিএফ থেকে অর্থায়ন করেছে ১৩১৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এডিআর ৯৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তাদের আমানত ১১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। বিনিয়োগ ১২ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত ১৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা চার হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। তাদের বিনিয়োগ ২৩ কোটি ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তারা ইডিএফ থেকে অর্থায়ন করেছে ১৪২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এডিআর ৯৩ দশমিক ২১ শতাংশ। তাদের আমানত ১৭ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জমা আছে ৫৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিনিয়োগ ১৭ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তারা ইডিএফ থেকে অর্থায়ন করেছে ৬৯২ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের শরিয়াহ শাখায় আমানত এক হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। তাদের নিজস্ব আমানত ১৯৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিনিয়োগ করেছে ১৪৭৩ কোটি টাকা। তারা বিনিয়োগ করেছে ৯৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের শরিয়াহ শাখা সীমালঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করেছে ১২২ দশমিক ৮২ শতাংশ। ব্যাংকটির আমানত এক হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। তাদের নিজস্ব আমানত ২০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে তারা বিনিয়োগ করেছে দুই হাজার ২৬ কোটি টাকা।