জাতীয় সংসদের হুইপ শেরপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগ সংসদ-সদস্য (এমপি) আতিউর রহমান আতিক যেন শেরপুরের অঘোষিত রাজা হয়ে উঠেছেন। তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন দখল, দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিজের নামে ডজনখানেক বাণিজ্যিক স্কুল-কলেজ ছাড়াও বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিনি নিজের নামে আতিউর রহমান মডেল কলেজ, আতিউর রহমান মডেল গার্লস স্কুল, আতিউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, আতিউর রহমান আলিম মাদ্রাসা, আতিউর রহমান হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল এবং আতিক নগরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন নিজ এলাকায়। এছাড়া শেরপুর তিনআনি বাজারে বিলাসবহুল বাড়ি, গ্রামে ৩০ একর জমিতে বাগানবাড়ি, ঢাকার বসুন্ধরা ও বনশ্রীতে দুটি প্লট, রাজউকের প্লট, ধানমন্ডি ও গুলশানে দুটি ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে আছে শত কোটি টাকার সম্পদ।
অভিযোগ আছে, শেরপুরে বিভিন্ন বাণিজ্যক ভবন নির্মাণ করে তিনি সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, আয়কর অফিসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তার ভবনে ভাড়া নিতে বাধ্য করেছেন। এছাড়া শেরপুর সদর উপজেলায় দুরুঙ্গি বিলে ৬০ একর ফসলি জমি এবং সদরে তেঁতুলিয়া এলাকায় প্রায় ৬ একর জমি রয়েছে তার। অন্যদিকে ঢাকার লালমাটিয়ায় তার একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট এবং ঢাকার নিকুঞ্জ ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা যায়।
এছাড়া নিজের স্ত্রী ও মেয়েদের নামে শতভরি স্বর্ণালঙ্কার ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এফডিআর রয়েছে। অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় (২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর) দাখিল করা হলফনামায় বাস্তবতার সঙ্গে রয়েছে আকাশ-জমিন ফারাক। হলফনামায় বাৎসরিক আয় হিসাবে কৃষিখাত থেকে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা, চাকরি সম্মানি ভাতা হিসাবে ১১ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং মাছ চাষ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া অস্থাবর সম্পদ হিসাবে নিজের নামে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ১০০ ভরি স্বর্ণলঙ্কার উপহার পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
স্থাবর সম্পদ হিসাবে নিজের নামে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং স্ত্রীর নামে ২১ লাখ ৯ হাজার টাকার কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লিখিত সম্পদ ছাড়াও জমি কেনার কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এমপি আতিক নিজের ক্ষমতা এবং কর্মকর্তাদের বদলির ভয় দেখিয়ে সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও ভূমি অফিসকে দিয়ে শেরপুর সদরের বিভিন্ন এলাকায় ১৯৯৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে কেনা আমমোক্তারনামার মাধ্যমে গ্রহণ, হেবাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২১টি দলিল সম্পাদিত করেছেন, যার নথি যুগান্তরের হাতে এসেছে।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এসব জমি কিনেছেন তিনি। ওই সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক শত কোটি টাকা। এমপি আতিককে ২০১৩ সালের ৬ অক্টোবর ৮৯১০ নম্বর দলিলে আন্দারিয়া এলাকার কবিরপুর আন্দারিয়া মৌজার আর ও আর ১২৬৫ ও বিআরএস ১২৩০ খতিয়ানের আর ও আর ২৯ এবং বিআরএস ২ দাগের ২২ কাতে ১০ দশমিক শতক এবং আর ও আর ২৯ এবং বিআরএস ৩ দাগের ২৯ কাতে ১০ শতক মোট ২০ শতক জমি এমপির নামে লিখে দেন আবুল হোসেন ও আব্দুল সেখ।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ৮৮৩৯ নম্বর দলিলে বারঘরিয়া মৌজায় আর ও আর ৬৫ ও বিআরএস ৮৭ খতিয়ানের আর ও আর ৯৪ এবং বিআরএস ১৬৪নং দাগের ১২৭ কাতে ৩৫ শতাংশ জমি লিখে দেন আব্দুল বারিক ও মৃত নছিমদ্দিন। এছাড়াও ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ৮৮৩৯ নম্বর দলিলে বারঘরিয়া মৌজায় আর ও আর ৬৫ ও বিআরএস ৮৭ খতিয়ানের আর ও আর ৯৪ এবং বিআরএস ১৬৪নং দাগের ১২৭ কাতে ৩৫ শতাংশ জমি লিখে দেন আব্দুল বারিক ও মৃত নছিমদ্দিন।
তথ্যমতে, আতিউর রহমান আতিক দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন শেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য, শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে শেরপুর সদর-১ আসন হতে পরপর ৫ বার এমপি এবং দুবার জাতীয় সংসদে হুইপ মনোনীত হয়েছেন। বারবার নির্বাচিত হওয়ার ফলে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে মনোনয়ন বাণিজ্য, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকরণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন, নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হতে ঘুস নেওয়া ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও অদৃশ্য কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। রহস্যজনকভাবে সে সময়ে তাকে অব্যাহতি দেয় দুদক।
শেরপুরের সব সিন্ডিকেট হুইপকন্যা ডা. শারমিন আক্তার অমির নিয়ন্ত্রণে। বাবার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলেন ‘ডোন্ট কেয়ার’ নীতিতে এবং শেরপুরজুড়ে তৈরি করেছেন নিজের রাজত্ব। এছাড়া অভিযোগ আছে, এমপি আতিকের স্ত্রী শামছুন্নাহার শান্তা শেরপুর শহরের চন্দ্রকান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে কর্মরত রয়েছেন।
স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ-বদলিসংক্রান্ত বিষয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুস নেন তিনি। স্বামীর ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে অধিকাংশ সময় তিনি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। মাস শেষে বেতন তোলেন। এখানেই শেষ নয়, বাবার ক্ষমতার জোরে এমপিকন্যা শারমিন বর্তমানে শেরপুর সদর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময় স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্বাচনি আচারণবিধি লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছেন।
এ কারণে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট চাওয়ার অভিযোগে জেলা নির্বাচন অফিস তাকে লিখিতভাবে সতর্ক করেছিল। তবু তিনি শোধরাননি। তার ইচ্ছামতো বিভিন্ন অনিয়ম করে চলেছেন। স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হুইপ আতিকের কোনো ছেলে না থাকায় বাবার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি পাইয়ে দিতে একক আধিপত্য রয়েছে অমির।
স্থানীয়দের মতে, অমি বাবার রাজকীয় ফ্ল্যাটের ৬ তলায় নতুন হাওয়া ভবন খুলে বসেছেন। তার সাক্ষাৎ পাওয়া ঠিক যেন সোনার হরিণ। অমির সাক্ষাৎ পেতে দিতে হয় নামিদামি উপঢৌকন ও স্বর্ণালঙ্কার। সাক্ষাতের অনুমতি পেলে কাজ পেতে শুরু হয় দরকষাকষি। অমির ইচ্ছে ছাড়া চাকরি বা কাজ পাওয়ার নজির শেরপুরে এক কথায় অসম্ভব।
জানা যায়, এমপি আতিক ২০০৯ সালে হুইপ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয়ভাবে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দলীয় পদবাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল, মাদক কারবার, চাঁদাবাজিসহ জবরদস্তি করে অবৈধভাবে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া এমপি আতিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অসহায় পরিবারের সদস্যদের জমি আত্মসাৎ ও অর্থের বিনিময়ে পদবাণিজ্য ও কমিটি করার নামে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও নেতাকর্মীদের থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
গোয়েন্দা বিভাগের প্রকাশিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে জানা গেছে, শেরপুর শহরের মাধবপুর এলাকায় ২০১০ সালে ৮০ শতাংশ জায়গার ওপর সাত তলাবিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা তৈরি করেছেন এমপি আতিক। যার বর্তমান আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। তিনআনি বাজারে তার খরচে শ্বশুরকে একটি বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন। যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। শেরপুর সদরে তারাকান্দি বাজারে ভীমগঞ্জ এলাকায় ৮ থেকে ১০ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান মডেল কলেজ। যার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
এসব ব্যাপারে হুইপ আতিউর রহমান আতিক বলেন, আমি কোনো অবৈধ সম্পদ অর্জন করিনি। আমার নির্বাচনি হলফনামা ও সম্পদের সঙ্গে সব মিল আছে। তার ২১ দলিলে প্রচুর সম্পদের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার নিজের নামে আটটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সব আমার হলফনামায় লেখা আছে। জমির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, গ্রামের জমির দলিল তো থাকবেই। তবে কিছু দলিল মানুষ আমার নামে ভুল দেখিয়েছে। তার শ্বশুর রাজাকার ছিলেন এটা সত্য কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন। তিনি রাজাকার নন মুসলিম লীগের লোক ছিলেন। সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাতে ফোন কেটে দেন তিনি।