অনেক পরিবারের করোনার ক্ষত এখনও শুকায়নি। করোনাভাইরাসের প্রকোপে অর্থনৈতিকভাবে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসায় লোকসান গুনেছে তাদের অনেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঈদের বাজারে ভাটা পড়েছে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে।
দি দোকানে কেনাকাটা করছিলেন এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। ঈদের ছুটিতে পাবনায় বাড়িতে যাবেন। বাড়িতে বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান আছে তার। পরিবারে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি তিনিই। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগে কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে যাচ্ছেন ঢাকা থেকে। তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের।
আব্দুল বাতেন নামের এই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি একটা কোম্পানিতে চাকরি করতাম। বেতন ভালোই ছিল। ঢাকায় নিজে একা থেকে খেয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারতাম। আমার টাকায় বাড়িতে বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান চলতো। কিন্তু করোনার সময়ে আমার চাকরিটা চলে যায়। অবস্থা মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ার পর অনেক কম বেতনে একটা চাকরি নেই। এক বছর হয়নি বলে এবার ঈদে বোনাসও পাইনি।’
পরিবারের জন্য কী কী নিলেন জানতে চাইলে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘যখন বেশি বেতনের চাকরি ছিল, তখন বাবা মায়ের জন্য যা যা প্রয়োজন নিজেই নিতাম। স্ত্রীকে টাকা পাঠিয়ে বলতাম, যা যা লাগে নিয়ে নিও। কিন্তু এবার সে অবস্থা নেই। মায়ের জন্য একটা কাপড়, বাবার জন্য একট পাঞ্জাবি নিলাম। স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ি কিনেছি ও বাচ্চাদের জন্য জামা-জুতা নিলাম। নিজে কিছুই নিতে পারি নাই।’
মুদি দোকানের কেনাকাটা কেন ঢাকা থেকে নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার সব জিনিসেরই দাম বাড়তি। নিজের মতো করে হিসাবের টাকায় অল্প অল্প করে নিচ্ছি। যা নিয়ে যামু, বাড়িতে তাই রান্না করবে। কিন্তু টাকা পাঠালে তো বেশি করে পাঠাতে হতো।’
ঈদের কেনাকাটা কোথা থেকে করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গুলিস্তানে গিয়ে অল্প দামেই সব কিনেছি।’
বাড্ডা বাজারে আরেকটি মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কী কী কিনবেন তা দেখছেন পঞ্চাশঊর্ধ্ব এক ব্যক্তি। একটি ব্যাংকের অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি জানান, পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই একটি ছোট বাসা ভাড়া করে থাকেন তিনি।
কী কী কিনছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কী আর নিব রে বাবা, জিনিসের যে দাম। ঘরে তো কিছুই মানান যায় না, কিন্তু আমার তো দম বের হয় অবস্থা।’ ঈদে কী কী কেনাকাটা করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার বউ বাচ্চাদের বেশি কিছু দিতে পারি নাই। নিজে তো কিছুই নেই নাই। বয়সও নাই, পয়সাও নাই।’
বাড্ডা লিংকরোড গুদারাঘাট বাজারে মুদি দোকানে কেনাকাটা করছেন দুই তরুণ। দুজনেই একই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, বাড়িও একই জেলায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে মুদি দোকানে ভিড় করেছেন তারা। জানতে চাইলে তাদের একজন রাসেল বলেন, ‘বাড়িতে যামু। মা আছে আর ছোট বোন আছে। অল্প টাকার চাকরি করি, এজন্য বেতনের টাকা থাকতে থাকতেই অল্প অল্প করে সব একসাথে কিনা নিচ্ছি।’
‘সব কিছুরই দাম বাড়তি। যেটাতেই হাত দেই, সেটার দামই বেশি।’ এমনটাই মন্তব্য করছিলেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে ফুটপাতের মার্কেটে পাঞ্জাবি কিনতে আসা রাসেল মিয়া। ঢাকাতে অল্প টাকা বেতনে চাকরি করেন তিনি। বায়তুল মোকাররমের পাশে পাঞ্জাবি কিনতে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখছেন।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব কিছুরই দাম বেশি। ফুটপাতেও এখন পাঞ্জাবির দাম আটশ’-নয়শ’ টাকা। চার-পাঁচশো টাকায় যেটা পাওয়া যায়, সেটা পছন্দ হয় না।’
সজীব নামে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের এক পাঞ্জাবি বিক্রেতা বলেন, ‘এবার সব পাঞ্জাবি কেনাতে দাম বেশি পড়ছে। আগে ৩০০ টাকায় পাঞ্জাবি কিনতে পারতাম। এবার সেটা কিনতে হয়েছে ৪০০ টাকায়। আমরাও তো লাভ করি। খাইতে তো হইবো।’
একই দোকানে দুই বছরের বাচ্চার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে এসেছেন এক ব্যক্তি। বিক্রেতা ৫০০ টাকা দাম চাইলে ওই ক্রেতা ৩০০ টাকা বলেন। দামে না মিললে চলে যান ওই ক্রেতা। যাওয়ার সময় ‘বাচ্চাদের পাঞ্জাবির দাম এতো কেন?’মন্তব্য করলে বিক্রেতা বলেন, ‘এক হাজার টাকা দামেরও আছে আমার কাছে। নিবেন কিনা।’
‘আপনি তো কেনাকাটা করছেন। জিনিসের দাম কেমন। আপনার আয়ে সংসার চলে। তাতে কেমন চলছেন?’ প্রশ্ন করলে মাজেদুল ইসলাম নামে মধ্যবয়সী এক ক্রেতা বলেন, ‘জিনিসের দাম বাড়ে। তেলের দাম ৯০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা হইতে কয়দিন সময় নিছে। কিন্তু বেতন তো বছরে একবারও বাড়ে না। সব কিছুরই দাম বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় আমার ইনকাম তো বাড়ছে না। ঢাকা শহরে থাকি। পরিবারের জন্য কিছু খরচ দেই। তাও যদি এখন ঠিকমতো চলতে না পারি, আফসোস করা ছাড়া তো আমাগো মতো সাধারণ পাবলিকের কিছু করার নাই।’