রাজধানীর কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের একটি বাসায় নির্মম নির্যাতনে হেনা নামে ১০ বছর বয়সী শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। পুলিশের সুরতহালে ওঠে আসে হেনার শরীরে অসংখ্য নতুন ও পুরাতন ক্ষত চিহ্ন। গৃহকর্ত্রীর নির্মম নির্যাতনেই হেনার মৃত্যু বলে ধারণা করছে পুলিশ।
কিন্তু ঘটনার তিন পেরিয়ে গেলেও সেই অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী মোছা. সাথী পারভীন ডলির খোঁজ মেলেনি।
শুধু কলাবাগান থানা পুলিশ নয়, সাথীকে গ্রেপ্তারে ছায়া তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব। তবে কোনো সংস্থাই সাথীর খোঁজ দিতে পারছে না।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাথী ধূর্ত প্রকৃতির। তিনি যে অপরাধী তার স্পষ্ট প্রমাণ তিনি ঘটনার পরপরই বাসা থেকে পালিয়েছেন। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এড়াতে নিজের ব্যবহৃত কোনো মোবাইল সঙ্গে নেননি, ফেলে গেছেন। যে কারণে তার অবস্থান শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোনের কয়েক শ’ মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে সাথীর অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের ৭৭ নং ভবনের দ্বিতীয় তলায় ফ্ল্যাট ই-১ তে সাথী পারভীন ডলি তার শিশু সন্তান আর ওই গৃহকর্মী হেনাকে নিয়ে বসবাস করতেন। গত তিন বছর ধরে নিহত গৃহকর্মী হেনা ওই বাসায় কাজ করছিল।
গত শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকালেও ওই শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা হয়। শিশুটি মারা যাওয়ার পর রান্নার সব কিছু আর মোবাইল ফেলে পালিয়ে যান গৃহকর্ত্রী সাথী। শুক্রবার(২৫ আগস্ট) রাতে অজ্ঞাত ফোনে গৃহকর্মী মৃত্যুর প্রাথমিক তথ্য পায় কলাবাগান পুলিশ। এরপর রাত দেড়টার দিকে কলাবাগান থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৭৭ নং ভবনে গিয়ে বেশ কটি বাসায় খোঁজও নেয় পুলিশ। ওই ভবনটিতে ৪৪টি ফ্ল্যাট। মধ্যরাতে সব ফ্ল্যাটে খোঁজ নেওয়া বেগতিক বুঝে ফিরে আসে পুলিশ। পরদিন শনিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ি মালিক এবং সোসাইটির লোকজন নিয়ে ভবনটির দ্বিতীয় তলা ই-১ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতর থেকে গৃহকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
সুরতহালে পুলিশ দেখতে পায়, হেনার শরীরে অনেক নতুন ও পুরাতন আঘাতের চিহ্ন। মুখে ফেনা, শরীর ফোলা। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতে মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুদিন পর তার পরিচয় শনাক্ত করে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত গৃহকর্মীর নাম মোছা. হেনা (১০)। বাবার নাম হক মিয়া। ময়মনসিংহ মুক্তাগাছায় হেনার গ্রামের বাড়ি। বাবা ও মা দুজনই মৃত। তিন বছর আগে ময়মনসিংহে একটি ট্রেনিং করতে গিয়ে এতিম হেনার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসেন গৃহকর্ত্রী সাথী।
মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) দুপুরে কলাবাগান থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, হেনার বাবা ও মা দুজনই মারা গেছেন। এতিম হেনাকে তিন বছর আগে ঢাকায় নিয়ে আসেন গৃহকর্ত্রী সাথী। নির্যাতনে মারা যাওয়া হেনার পরিচয় শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।
সাথী কোথায়, কেনই বা গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না তাকে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, সাথীর বাসায় চারটি মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে তার সঙ্গে কোনো মোবাইল ফোন নেই। জব্দ করা চার মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে কয়েক শ’ নাম্বারে যোগাযোগ করা হয়েছে, কিন্তু কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি।
ওসি বলেন, সাথীকে আইনের আওতায় আনতে তার ভাই-বোনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, সম্ভাব্য সব ধরনের সন্দেহজনক মোবাইল নম্বরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। কিন্তু সাথী ধূর্ত। তাকে কোনো নম্বরেই সংযুক্ত কিংবা যোগাযোগের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। নিকট ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে না সাথী। সাথীর বাবার বাড়ি পাবনা সদরের টেবুনিয়ার ঘরনাগড়ায়। সেখানেও লোকাল পুলিশের সহযোগিতায় অভিযান চালিয়েও মেলেনি সাথীর সন্ধান।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২ ব্যাটালিয়নের একটি টিম ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করছে। অভিযুক্ত ও মামলার একমাত্র আসামি গৃহকর্ত্রী সাথী পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাথী ঢাকার বাইরে যেতে পারেননি। সবগুলো ঢাকার আউট পয়েন্টে সাথীর ছবি সরবরাহ করে নজরদারি করা হচ্ছে। সাথী ঢাকাতেই অবস্থান করছে বলে নিশ্চিত হয়েছি। তবে তিনি মোবাইল ব্যবহার না করায় অবস্থান শনাক্ত করা যাচ্ছে না।