বর্তমান সরকারের ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করে কানেকটিভিটি সুদৃঢ় করা, সাশ্রয়ী মূল্যে ডিভাইসের ব্যবস্থা ও মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ানো, ইন্টারনেটের মূল্য কমানোসহ বেশকিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক (টিআরএনবি) ও রবির উদ্যোগে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব মতামত তুলে ধরেন তারা।
গোলটেবিল আলোচনায় বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন ৬জি নিয়ে কাজ করছে তখনও আমরা ৫জিতে যেতে পারিনি। আমাদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট, ডাটা কমিউনিকেশন ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ইউনিভার্সিটিগুলোর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয় এবং আইসিটি, তথ্য, টেলিকমসহ মিনিস্ট্রিগুলোকে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, যদি আমার ঘর স্মার্ট না হয়, আমি যদি স্মার্ট না হই, তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশও সম্ভব হবে না। এজন্য স্মার্ট এডুকেশন, স্মার্ট এগ্রিকালচারের প্রয়োজন। তাই সমন্বিতভাবে এগোতে হবে। দেশের মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মহাসচিব এস এম ফরহাদ বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে স্মার্ট ডিভাইস যারা ব্যবহার করেন তাদের স্মার্ট লিটারেসির প্রয়োজন। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লিংকেজ, স্মার্ট ডিভাইসের ক্ষেত্রে উচ্চ করহার তুলে দেওয়া প্রয়োজন।
ডেটা সেবার প্রসারে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, আমাদের স্বচ্ছতা, কানেকটিভিটি ও দুর্নীতি দূর করতে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ের জায়গাটা খুব দরকার। বৈশ্বিক তুলনামূলক প্রেক্ষাপটে আমরা অনেক কম খরচে ডেটা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবুও সেটা অনেকের কাছেই সাশ্রয়ী হচ্ছে না মূলত উচ্চ কর হারের কারণে। করের বোঝা একটু কম হলে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে গ্রাহকদের ডেটা সেবা দেওয়া সম্ভব।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য এখন আমাদের টেলিকম, আইটি, ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে এফিসিয়েন্সি বাড়ানো, সার্ভিস কস্ট কমানো, ডিজিটাল লিটারেসি, ডিভাইস পারচেজিং ক্যাপাসিটি বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মোবাইল অপারেটরদের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এজন্য প্রয়োজনে ইনসেনটিভ দেওয়া উচিত।
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (আইটি অ্যান্ড বিলিং, ইনোভেশন) নুরুল মাবুদ চেীধুরী বলেন, আমাদের আইসিটি উপদেষ্টা স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য রোবোটিকস, সাইবার সিকিউরিটিসহ চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। সমন্বিত ডাটা ম্যানেজমেন্ট করতে পারলে আমরা স্মার্ট হতে পারব। নগদের চিফ বিজনেস অফিসার শেখ আমিনুর রহমান বলেন, টেলিকম দিয়েই ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়, এখন সবার কোলাবোরেশন হলে স্মার্ট বাংলাদেশ খুব বেশি দূরে নয়।
এটুআইয়ের চিফ ই-গভর্ন্যান্স স্ট্র্যাটেজিস্ট ফরহাদ জাহিদ শেখ বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ সফল হওয়ার পরে আইসিটি উপদেষ্টা স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য সিটিজেন, সোসাইটি, ইকোনমি ও গভর্নেন্স এই চারটি পিলারের কথা বলেছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ কোয়ানটিটি নির্ভর না হয়ে কোয়ালিটি নির্ভর হবে। জিএসএমএ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মোবাইল ফর ডেভেলপমেন্ট পরিচালক রাহুল সাহা বলেন, স্মার্ট ডিভাইসের জন্য বাংলাদেশের ট্যাক্স পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষে। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।
বাংলালিংকের সিসিও তাইমুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে টেলিকম অপারেটররা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু পৃথিবীর সর্বোচ্চ ট্যাক্স পলিসি বাংলাদেশে। আমাদের পলিসিতে নজর দিতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সরকারের অনন্য পদক্ষেপ এবং টেলিকম অপারেটরদের সহযোগী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন টিআরএনবি সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। টিআরএনবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমীর কুমার দে এতে সভাপতিত্ব করেন।
গোলটেবিল আলোচনায় জানানো হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন ২০২১ প্রণয়ন এবং এর সফল বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আগামী ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বরের মধ্যে তা বাস্তবে রূপ নেবে। ভবিষ্যৎমুখী স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা/নীতি প্রণয়ন জাতির এই অগ্রগতিকে সহজতর করছে।
ভিশন ২০২১ এর আওতায় ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল উদ্ভাবন এবং ডিজিটাল অর্থনীতির মতো নেওয়া উদ্যোগগুলো ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। সরকারি ডিজিটাল সেবা দেওয়া প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণ মানুষের জন্য নতুন নতুন সুযোগ উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি গড়ে তুলছে ডিজিটাল সেবা গ্রহণে তাদের মানসিকতা। ডিজিটাল কানেকটিভিটি ইকোসিস্টেমে গঠিত শক্তিশালী অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
টেলিযোগাযোগ সেবার হাত ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এর ফলে এখন যে কেউ ডিজিটাল/স্মার্ট অর্থনীতিতে নিজেকে আরও সম্পৃক্ত করার সুযোগ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে একটি বড় উদাহরণ সিঙ্গাপুরের স্মার্ট নেশন। সেদিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় একটি স্মার্ট নেশন ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে শিল্প পর্যায়ে কী অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।
চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আগে সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং ওই ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভ এবং সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এখন প্রয়োজন এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী চিন্তাধারার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। সরকার ইতোমধ্যে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন এবং প্রাথমিক কাজের ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে, যা সঠিকভাবে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। প্রতিটি খাত অনুযায়ী লক্ষ্য এবং চূড়ান্ত ফলাফল নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না।
স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১-এর চারটি মূল স্তম্ভ রয়েছে; যার প্রথম দুটি হল স্মার্ট নাগরিক এবং স্মার্ট সরকার- যার মাধ্যমে সব সেবা এবং মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তরিত হবে। অন্যদিকে স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট ইকোনমি স্মার্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এই চারটি স্তম্ভের আওতায় ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলো স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।