কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উত্তরণের পর স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে অর্থ বরাদ্দ। আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেটে ৩৫ হাজার ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। এটি সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চেয়ে পাঁচ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বেশি। তবে গত দুই বাজেটে টিকা কেনায় বড় অঙ্কের বরাদ্দ থাকলেও আগামীতে থাকছে না। কারণ এরই মধ্যে পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি। এ বরাদ্দ অনেকটাই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে যোগ হচ্ছে। পাশাপাশি সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের মূল বরাদ্দ থেকে কমানো হয়েছে সাত হাজার দুশই কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। এটি অনেক পুরোনো। কারণ এখানে প্রকল্পের অধিকাংশ পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হচ্ছেন ডাক্তার। প্রকল্পের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে। যে কারণে স্বাস্থ্য খাতের টাকা যথাসময় যথাযথভাবে ব্যয় করতে পারেন না। এতে টাকা ব্যয়ে ধীরগতি সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের অভিজ্ঞ পিডিদের স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের অর্থ ব্যয় বাড়াতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। তবে আমি সন্দিহান যে, আগামী বাজেটে যে বরাদ্দ থাকছে পুরোপুরি সেটি ব্যয় করতে পারবে কিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, কোভিড-১৯ মহামারি উত্তরণের পর বিভিন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্র, মেডিকেল কলেজের শূন্য পদে লোকবল নিয়োগেও জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ কোভিড-১৯ মহামারির সময় স্বাস্থ্য খাতে জনবল সংকট বড় আকারে দেখা দেয়। এজন্য পরিচালনা খাতে বেতন-ভাতায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত চলতি অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় করোনাভাইরাস নির্মূলের টিকা কেনা বাবদ। এর আগে অর্থবছরে রাখা হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আগামী বছর এ খাতে কোনো বরাদ্দ থাকছে না। কারণ ইতোমধ্যে এ ভাইরাস সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ।
সূত্রমতে, আগামী বাজেটের সম্ভাব্য আকার সাত লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে নিট বরাদ্দ থাকছে ৩৫ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চলতি সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ আছে ২৯ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। চলতি সংশোধিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। বরাদ্দ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে নিট বরাদ্দ বাড়ছে পাঁচ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও অষ্টম বার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম আগামী বাজেটে থাকবে। বিশেষ করে চিকিৎসাসেবায় উচ্চ বিনিয়োগ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা বিজ্ঞানে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার অবকাঠামো তৈরি ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি আগামী বাজেটে শিক্ষার ব্যয় জনগণের নাগালের মধ্যে রাখা, নার্সিং শিক্ষার আধুনিকায়ন, নার্সিং কলেজ উন্নয়ন, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, নার্সিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজে রূপান্তর করার কার্যক্রমের ঘোষণাও থাকছে। এছাড়া পরিবার কল্যাণ, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সূত্র আরও জানায়, ২০২০ সালের প্রথম থেকে ২০২২-এর শেষদিক পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর অতিমারির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের প্রকোভ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এই সময়ে জীবন-জীবিকা রক্ষায় স্বাস্থ্য খাত শক্তিশালী ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। তবে আগামী অর্থবছর এ থেকে বেরিয়ে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন কার্যক্রমকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। কারণ কোভিড-১৯ মোকাবিলা করতে গিয়ে উন্নয়ন খাতে নজর কম পড়েছে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা শিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকদের গবেষণা জোরদার করা, বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এছাড়া জোর দেওয়া হবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিশ্চিত করা। এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মোট উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ থাকছে ১৫ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এটি চলতি বছরের তুলনায় তিন হাজার ১৯৯ কোটি টাকা বেশি। সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাস্থ্য খাত কতটা দুর্বল এটি হারে হারে উপলব্ধি করা গেছে করোনাকালীন। ফলে এ খাতে একদিকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কারণ এই সক্ষমতার অভাবে চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে সাত হাজার দুইশ কোটি টাকা কমিয়ে ২৯ হাজার ৬২১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটের হিসাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ২২ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বরাদ্দ দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা।