সাংবাদিকদের অধিকার আদায় এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আর নেই। শনিবার দুপুর দেড়টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে, ১ মেয়ে, নাতি-নাতনি, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, দ্য নিউজ টুডে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও দ্য ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ডের সম্পাদক ছিলেন। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, সমপ্রতি তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে তিনি বাসায় চিকিৎসা নেন। পরবর্তীতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৬ই ডিসেম্বর রাতে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিছুদিন অধ্যাপনা শেষে ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান অবজারভারের চাকরি ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন। স্বাধীনতার পর আবারো অবজারভারে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কাজ করেন। সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের জন্য রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। গত ২১শে ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এবং দি নিউজ টুডে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক, দ্য ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ডের সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি চারবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাংবাদিকদের ফেডারেশন সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া সাংবাদিক সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া এসোসিয়েশনের (সাফমা) সভাপতি ছিলেন। ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। প্রথমে ছাত্রলীগ এবং পরে বাংলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
সাংবাদিকদের দাবি আদায়ে লড়াকু সৈনিক: সাংবাদিকদের অধিকার আদায় এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ প্রদর্শক ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। সবশেষ অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টসের অপব্যবহার ও সাংবাদিকদের হয়রানি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনের সরব কণ্ঠস্বর ছিলেন। সকল চাপের মধ্যেও সাংবাদিকদের কলমকে শক্তিশালী করার কথা বলতেন তিনি। দেশের সকল প্রতিষ্ঠান যখন দলগত বিভক্তিতে তিক্ত তখন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সবসময়। সাংবাদিকতার বাইরে তিনি নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, আরব্য রজনী, পারস্য রজনী। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ শেরেবাংলা পদক. মাওলানা আকরাম খাঁ স্বর্ণপদক, নরসিংদী প্রেস ক্লাব পদক, মাদকবিরোধী ফেডারেশন স্বর্ণ পদকসহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা অর্জন করেন। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব শোক প্রকাশ করেছেন।
সম্পাদক পরিষদের শোক: সম্পাদক পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। গতকাল শনিবার বিকালে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় এ শোক জানানো হয়। বিবৃতিতে তারা বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বাধীন সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে যারা ভূমিকা রেখেছেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ তাদের অন্যতম। তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা ও দক্ষ নেতৃত্বগুণ পরিষদকে বিকশিত হতে সহায়তা করেছে। দি ফিন্যান্সিয়াল হেরাল্ড-এর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ (৭৭) সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে গত ১৬ই ডিসেম্বর রাতে তাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গতকাল দুপুর দেড়টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও দি নিউজ টুডে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে দি ডেইলি স্টারের উপ-সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ জাতীয় প্রেস ক্লাবের চারবারের নির্বাচিত সভাপতি। অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকতায় ১৯৯৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন।