আওয়ামী লীগের বিবদমান দুগ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় পালটা পালটি মামলাকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীর বসুরহাট (কোম্পানীগঞ্জ) ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সৃষ্টি হয়েছে ভীতিকর পরিস্থিতির। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে একরকম স্থবিরতা। এমন অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি চান স্থানীয়রা।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ঘটনায় পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জার অনুসারীরা দুটি ও পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৩৫ জন।
আর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীরা দুটি এজাহার থানায় জমা দিলেও তা মামলা হিসাবে রেকর্ড করেনি পুলিশ। হত্যা মামলার এজাহার থেকে কাদের মির্জার নাম বাদ দিতে বাদীকে চাপ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে শুক্রবার সকালে পৌর ভবন থেকে বেরিয়ে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শোডাউন করেন কাদের মির্জা। আর কোম্পানীগঞ্জ অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বাদলের অনুসারী ও কাদের মির্জার ভাগিনা মাহবুবুর রশীদ মঞ্জু। আর বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হওয়া মিজানুর রহমান বাদলকে শুক্রবার আদালতে হাজির করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সংঘর্ষে জড়িতদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের ‘সাঁড়াশি’ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পাশাপাশি ৭টি ককটেল ও বেশকিছু লাঠিসোটা উদ্ধার করেছে। গ্রেফতার এড়াতে দুগ্রুপের নেতা-কর্মী ও অস্ত্রবাজরা আত্মগোপনে চলে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনো অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন আছে।
বাদল গ্রুপের অন্যতম নেতা ও কাদের মির্জার ভাগিনা মাহবুবুর রশীদ মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ এক পক্ষের মামলা নিচ্ছে। আরেক পক্ষের মামলা নিচ্ছে না। পুলিশের এই আচরণের প্রতিবাদে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে কোম্পানীগঞ্জ অচল করে দেওয়া হবে। আর উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী থাকবেন ওবায়দুল কাদের।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষে নিহত আলাউদ্দিনের ভাই এমদাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টায় থানায় এজাহার জমা দেই। কিন্তু এজাহারে কিছু ভুল থাকার কথা বলে পুলিশ তা মামলা হিসাবে রেকর্ড না করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। শুক্রবার সকালে ফের থানায় গিয়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। এরমধ্যে এজাহার থেকে কাদের মির্জার নাম বাদ দিতে পুলিশ আমাকে চাপ দেয়। কিন্তু কোনো চাপের কাছে আমি নতিস্বীকার করব না। আদালতে মামলা দায়ের করব।’
মামলা রেকর্ড না করার বিষয়ে জানতে পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসনের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। জেলার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামীম কবির ও কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মীর জাহিদুল হক রনির কাছে জানতে চাইলে তারা কেউই এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
হত্যা মামলার এজাহার : পুলিশ সূত্র ও নিহত আলাউদ্দিনের ভাই এমদাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ৪ পৃষ্ঠার কম্পিউটার টাইপ করা একটি এজাহার কোম্পানীগঞ্জ থানায় জমা দেন এমদাদ হোসেন। ওই এজাহারে বসুরহাট পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আব্দুল কাদের মির্জা, তার ভাই শাহাদাত হোসেন ও ছেলে মির্জা মাশরুর কাদের তাশিকসহ ১৬৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয় আসামি তালিকায়। এতে বেকায়দায় পড়ে পুলিশ।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে থানায় রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এরপর বাদীকে তারা মামলার সাক্ষী পরিবর্তন ও আসামি তালিকা থেকে কাদের মির্জার নাম বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু এজাহার দাখিলকারী তাতে রাজি না হলে পুলিশ পাহারায় তাকে বাড়িতে রেখে আসা হয়।
এরপর বিভিন্নভাবে তাকে চাপ দেওয়া হয়। চাপে নতিস্বীকার না করে এমদাদ হোসেন শুক্রবার সকালে সাড়ে ১০টার দিকে ফের থানায় যান। ৪ ঘণ্টার বেশি সময় তিনি থানার অফিসার ইনচার্জের কক্ষে অবস্থান করে মামলা দায়েরে ব্যর্থ হয়ে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় তিনি আদালতে মামলা দায়ের করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
খিজির হায়াতের স্ত্রীর মামলার এজাহার : পরিবারের অভিযোগ, ৮ মার্চ রূপালী চত্বর সংলগ্ন আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে কাদের মির্জা ও তার অনুসারীদের হাতে মারধরের শিকার হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান।
এ ঘটনায় ৯ মার্চ খিজির হায়াত খানের স্ত্রী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আরজুমান পারভীন কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন। ওই এজাহারেও কাদের মির্জা, ভাই শাহাদাত হোসেন ও ছেলে মির্জা মাশরুর কাদের তাশিকসহ ৯৮ জনের নাম দেওয়া হয় আসামি তালিকায়। চার দিনেও সেই এজাহার রেকর্ড করেনি পুলিশ।
শুক্রবার দুপুরে থানায় দাঁড়িয়ে খিজির হায়াতের স্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘মির্জা কাদের ও তার অনুসারীরা আমার স্বামীর ওপর হামলা চালিয়েছে। মারধর করে তার গায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেই ছবি গণমাধ্যমেও এসেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার ওপর এমন আঘাত মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসীও দেখেছে। অথচ কাদের মির্জা ও তার পরিবারের সদস্যদের আসামি করায় পুলিশ মামলা নিচ্ছে না।’
মির্জার অনুসারীদের দুটি মামলা : মঙ্গলবার কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদলের গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনার পরদিন পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করার পরই বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয় বাদলকে। এরপর বৃহস্পতিবার কাদের মির্জার অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা আরিফুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল, আওয়ামী লীগ সভাপতি খিজির হায়াত খান, সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী, কাদের মির্জার দুই ভাগিনাসহ ৯৭ জনকে আসামি করা হয়। শুক্রবার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র অফিসের সহকারী নুর নবী স্বপন বাদী হয়ে পৌর ভবনে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছেন। এই মামলায়ও প্রায় একই ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। দুটি মামলায়ই মিজানুর রহমান বাদলকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে।
বাদল কারাগারে : শুক্রবার বেলা পৌনে ১টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মিজানুর রহমান বাদলকে নোয়াখালী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় পুরো আদালত চত্বর জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শোয়েব খানের আদালতে তোলা হলে জামিনের আবেদন করেন বাদলের আইনজীবীরা। শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে, শুক্রবার বিকালে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন বাদলের পরিবারের সদস্যরা। বাদলের স্ত্রী সেলিনা আক্তার কাকলী সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ দুই মাস ধরে কাদের মির্জা অপরাজনীতিতে লিপ্ত। তার কারণে দুজন মানুষের প্রাণ গেছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর বাদলের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর চালায়। ভয়ে এলাকার মানুষ ঘুমাতে পারে না। মিজানুর রহমান বাদল একজন শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপরও কাদের মির্জার কারণে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান মনোনয়ন পাননি। এখন তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। দ্রুত কাদের মির্জাকে গ্রেফতার ও বাদলের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
কাদের মির্জার শোডাউন : মঙ্গলবার সংষর্ষে হতাহতের ঘটনার পর শুক্রবার সকালে প্রথম বারের মতো পৌর ভবন থেকে বেরিয়ে ২০-২৫ জন অনুসারী নিয়ে পৌর এলাকায় ঘুরে বেড়ান কাদের মির্জা। নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। অনেকেই বলেছেন, বৃহস্পতিবার তার নেতাকর্মীদের মধ্যেও কাদের মির্জা গ্রেফতার হতে পারে বলে গুঞ্জন ছিল। স্ত্রী ও আইনজীবী পৌর ভবনে গিয়ে কাদের মির্জার সঙ্গে দেখা করেও এসেছিলেন।
গ্রেফতার হতে পারেন বলে তিনিও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে পাল্টে গেছে চিত্র। কাদের মির্জার বিরুদ্ধে কোনো মামলা রেকর্ড না করা এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা নেওয়ায় নেপথ্যে কী আছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। এলাকার অনেকেই মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত ভাই হয়তো ভাইয়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
আতঙ্কে সাধারণ মানুষ : কোম্পানীগঞ্জের পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্ক। প্রায় দুই মাস ধরে চলমান এই রাজনৈতিক সংকটের খেসারত দিতে হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও ব্যবসায়ীদের। থানা রোডের ফল বিক্রেতা ওমর ফারুক বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘর্ষে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা দূর হতে সময় লাগবে। তিন দিন দোকান বন্ধ থাকায় আমার ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা এই ভয়ের পরিবেশ থেকে মুক্তি চাই।’
একই রোডের আরেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দীপক আচার্য্য বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের মুখোমুখি অবস্থানে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সমাধান না হলে ক্ষতি আওয়ামী লীগের, তথা সরকারের। প্রসঙ্গত, গত দেড় মাস ধরে কাদের মির্জার সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের বিরোধ চলছে। এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে এক অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সময়ে দুপক্ষের দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে মঙ্গলবার সিএনজিচালক ও যুবলীগ কর্মী আলাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, আহত হন অর্ধশতাধিক। এর আগে আরেক সংঘর্ষে সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন।