গত বছর স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় তৈরি হয় নানা জটিলতা। বয়স জটিলতায় অনেক শিক্ষার্থী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারেনি। পরে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে ওইসব শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হয়। এবার এই জটিলতার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
বয়স নিয়ে ভর্তি জটিলতা নিরসনে শিক্ষা বোর্ডের বয়স সংক্রান্ত ১৯৬১ এর অধীনে ১৯৬৬ সালের বিশেষ অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয়েছে। ফলে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রথম শ্রেণিতে ৬ এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ১১ বছরের আইনটি চূড়ান্ত রূপ পেল। একই সঙ্গে ভর্তির সময়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এই সনদ অনুযায়ী শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের সব পরীক্ষার নিবন্ধন ও ফরম পূরণ করতে হবে। কোনোভাবেই জন্ম নিবন্ধন সনদের বাইরে বয়স নির্ধারণ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য বয়স হতে হবে ৬+ বছর। সেই হিসেবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির বয়স হতে হবে ১১+ বছর। ওই প্রজ্ঞাপনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী চলতি শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করতে পারছিল না।
কিন্তু এটি স্থায়ী সমাধান করতে গত ১০ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সভাপতি হেলালুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শিক্ষার্থীদের বয়স সংক্রান্ত জটিলতার জন্য পাকিস্তান আমলের ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর ভর্তি এবং বদলি সংক্রান্ত’ প্রবিধানটি বাতিল করা হয়। আর ভর্তির সময়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সনদ অনুযায়ী শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের সব পরীক্ষার নিবন্ধন ও ফরম পূরণ করতে হবে। কোনোভাবেই জন্ম নিবন্ধন সনদের বাইরে বয়স নির্ধারণ করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন জেনারেল রেজিস্ট্রার মানিক লাল বণিক জানান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইনের এই নির্দেশনা অনুসরণ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভর্তির সময় জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার করা হলেও পাবলিক পরীক্ষার জন্য পঞ্চম, অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় জন্ম নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী শিক্ষার্থীর বয়স নির্ধারণ হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং শিক্ষাগত সনদে জন্ম তারিখের মধ্যে গরমিল দেখা দেয়।
সভায় অন্যরা জানান, শিক্ষানীতি-২০১০ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স হবে ছয় বছরের বেশি। সে হিসাবে একজন শিক্ষার্থীর ১১ বছর বয়সে পিএসসি, ১৪ বছর বয়সে জেএসসি এবং ১৬ বছরের বেশি বয়সে এসএসসি পাস করার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, শিক্ষানীতি এবং ভর্তি নীতিমালা অমান্য করে শিক্ষার্থী ভর্তি এবং পাবলিক পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করা হয়।
পরে পাবলিক পরীক্ষার সনদ দাখিল করে বয়স কমানোর জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ কথিত সংশোধনের আবেদন করে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বয়স দুই থেকে চার বছর পর্যন্ত কমানোর নীতি বহির্ভূত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পাবলিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় এর ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং নীতিবহির্ভূতভাবে শিক্ষার্থীর বয়স কমানোর প্রবণতা রোধে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া সমীচীন হবে মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
জটিলতা যেখানে
শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৬ সালের অধ্যাদেশে প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত শিক্ষার্থীর ভর্তি এবং বদলি সংক্রান্ত একটি প্রবিধানে ১২ বছরের নিচে কোনো শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ভর্তি নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবিধান কার্যকারিতা হারালেও কোনো কোনো শিক্ষক এমনকি শিক্ষাবোর্ডের কোনো কোনো কর্মকর্তা মনে করেন, এই প্রবিধান অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থী ১৪ বছর বয়সে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারে। এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা। যা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর পরিপন্থী। এই ভ্রান্তি নিরসনের জন্য উপর্যুক্ত প্রবিধান বাতিল করা প্রয়োজন মর্মে সভায় মত প্রকাশ করা হয়।
বিস্তারিত আলোচনা শেষে স্থানীয় সরকারের ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে জন্ম নিবন্ধন সনদ গ্রহণ, সংরক্ষণ ও পাবলিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময়, ব্যবহার নিশ্চিত এবং শিক্ষার্থীর বয়স কমানোর প্রবণতা রোধ করতে মন্ত্রণালয় থেকে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে শিক্ষাবোর্ডেও ১৯৬৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে ঢাকা গেজেটের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত শিক্ষার্থীর ভর্তি এবং বদলি সংক্রান্ত প্রবিধানটি পরীক্ষান্তে বাতিল করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
এরপর ১ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর ভর্তি এবং বদলি সংক্রান্ত প্রবিধানটি বাতিল’-এর জন্য পরীক্ষান্তে মতামত দিতে মাউশিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বছর আদালতের নির্দেশে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিতে বয়সের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। আগামীতে এটি থাকবে কি না আমরা বসে নির্ধারণ করব। বয়সের প্রবিধান বাতিলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি শিক্ষাবোর্ডের বিষয়। জন্ম নিবন্ধনের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের সবার নিবন্ধন হওয়া উচিত মতামত দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেছেন।