গাছ কিন্তু গাছ না; আবার কাঠ কিন্তু কাঠ না- সত্যিই ধাঁধার মতো ব্যাপার। তবে উত্তরটা ভালো করেই জানেন সীমান্ত পথের অস্ত্র চোরাকারবারিরা। এই চক্রের সদস্যরা চোরাচালানের সময় নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় আগ্নেয়াস্ত্রকে ‘গাছ’ আর গুলিকে ‘কাঠ’ হিসেবে উল্লেখ করে। গত রোববার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ঢাকার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত একটি চক্রকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। ওই দিন চক্রের হোতা মো. হোসেনসহ চারজনকে পাঁচটি অস্ত্র, ৩০১ রাউন্ড গুলিসহ সিটিটিসি গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে ১০ রাউন্ড ছিল একে-৪৭ রাইফেলের গুলি। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় অবৈধ অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, মো. হোসেন চোরাকারবারি হলেও চট্টগ্রামে অস্ত্র বিক্রির একটি বৈধ দোকানেরও মালিক। ‘মফিজুর রহমান আর্মস কোং’ নামে ওই দোকানটি আসলে তার চোরাচালানের সাইনবোর্ড মাত্র। গত চার বছরে ওই দোকান থেকে একটিও বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করেননি তিনি। যদিও এ সময়ে তার হাত দিয়ে শত শত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পৌঁছেছে নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাছে। চোরাচালানের কাজ নির্বিঘ্ন রাখতে ভারতের মিজোরাম থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে রাঙামাটির বরকল, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট মো. হোসেন।
সিটিটিসি সূত্র আরও জানায়, অবৈধ অস্ত্রের কারবারে হোসেনের সিন্ডিকেটে বরকলের আদিবাসী নারী-পুরুষ ছাড়াও কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের একাধিক গ্রুপ রয়েছে। তাদের মধ্যে বরকল এলাকার একসময়ের হেডম্যান লালতন পাংখুয়া, তার মামা লালচাঁন পাংখুয়া, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আহল্লা করলডেঙ্গা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হামিদুল হক মান্নান ও তার দেহরক্ষী আদিলুর রহমান সুজন, রাউজানের আলী আকবর, চকরিয়ার সেলিম, জুয়েল, কক্সবাজার সদরের কাল্লু ওরফে ডাকাত কাল্লু, আহমেদ সফা এবং ঢাকার অস্ত্র ব্যবসায়ী স্বপন অন্যতম। তারা অস্ত্র কেনাবেচা ও বহনের সময় নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষা হিসেবে পিস্তল-রিভলবারের মতো ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রকে ‘সেগুন গাছ’, শটগান ও রাইফেলের মতো অস্ত্রকে ‘গজারি গাছ’ এবং গুলিকে ‘কাঠ’ বলে থাকে।
সিটিটিসি জানায়, রোববার যাত্রাবাড়ী থেকে মো. হোসেনের সঙ্গে তার সহযোগী লালতন পাংখুয়া, আদিলুর রহমান সুজন ও আলী আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গ্রেপ্তার চারজন ছাড়াও মামলায় স্বপন, হামিদুল হক মান্নান, আহমেদ সফা, সেলিম ও জুয়েলকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যান্টি-ইললিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মো. হোসেন রিমান্ডে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, লালতন পাংখুয়ার মামা লালচাঁন পাংখুয়া মিজোরামে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি অবৈধ অস্ত্র পাঠানোর কাজ তত্ত্বাবধান করেন। চোরাপথে আসা অস্ত্র বরকলের ছোট হরিণা, বড় হরিণা ও ছোট কাট্টালী সীমান্তের দুর্গম এলাকায় গ্রহণ করেন লালতন পাংখুয়া। তাকে স্থানীয় আরও দুই নারী সহযোগিতা করেন। এরপর সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ দেশের বিভিন্ন অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর হাতে তা চলে যায়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, হোসেনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার পর কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে তা সরবরাহের কাজটি করেন মান্নান চেয়ারম্যান ও তার লোকজন। সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, মো. হোসেন ২০১৫ সাল থেকে বৈধ অস্ত্রের আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কারবার করে আসছিলেন। তবে তিন-চার বছর ধরে শুধু বৈধতার একটি সাইনবোর্ড ব্যবহার করে আসছিলেন। আড়ালে তার সব কার্যক্রমই ছিল অবৈধ। তিনি আরও বলেন, হোসেন ও পাংখুয়া রিমান্ডে জানিয়েছেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে তারা অস্ত্র বিক্রি করতেন। তাদের কাছ থেকে ওই গ্রুপগুলোর নাম জানার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া তাদের সহযোগী পলাতক আসামিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, অবৈধ অস্ত্রের কারবারি হিসেবে মামলার আসামি হলেও তা জানেন না বোয়ালখালী উপজেলার আহল্লা করলডেঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদুল হক মান্নান। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তিনি সমকালকে বলেন, যাত্রাবাড়ীতে গ্রেপ্তার সুজনকে তার দেহরক্ষী বলা হলেও তা ঠিক নয়। তবে তিনি তাকে চেনেন। মান্নান চেয়ারম্যান নিজেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের কারবার করেন- সিটিটিসির এমন অভিযোগ ও মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি টেলিভিশনে দেখেছেন। গ্রেপ্তার হোসেনসহ বাকিদের কাউকে তিনি চেনেন না। তাকেও তারা চিনবে না। তিনি ঠিকাদারি করেন, অবৈধ কোনো কারবারে জড়িত নন।