টানা তিন মেয়াদ পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে আসছেন একজন সাবেক বিচারপতি। অবশ্য এর বিপরীতে কয়েকজন সাবেক আমলার নামও আলোচনায় রয়েছে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিইসি পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন সাবেক সচিব ড. এ টি এম শামসুল হুদা। তার নেতৃত্বেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরের দু’জন সিইসিও ছিলেন সাবেক আমলা। তারা হচ্ছেন সাবেক দুই সচিব কাজী রকিবউদ্দীন ও কে এম নূরুল হুদা।
বিচারপতিদের মধ্যে সর্বশেষ সিইসি পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিচারপতি এম এ আজিজ। ওয়ান-ইলেভেনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে এই বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তুমুল আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।
নির্বাচন কমিশন গঠন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিইসি নিয়োগ নিয়ে এরই মধ্যে নানামুখী আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার নতুন সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটির বৈঠকেও এ নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনায় সিইসি পদে একজন সাবেক বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়েই জোরালো সমর্থন এসেছে।
সূত্র জানায়, সিইসি পদের জন্য সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক বিচারপতি। তাদের মধ্যে আপিল বিভাগের দু’জন সাবেক বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও আবু বকর সিদ্দিকী আলোচনার পুরোভাগে রয়েছেন। মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ কিছুদিন আগে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। আবু বকর সিদ্দিকী গত বছরের ২৯ জুলাই অবসরে গেছেন।
সিইসি পদে কয়েকজন সাবেক আমলার নামও আলোচনায় এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদের সাবেক দুই সচিব মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম, পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সদ্য বিদায়ী সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সার্চ কমিটি পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম সুপারিশ করবে। অর্থাৎ আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সার্চ কমিটিকে এই সুপারিশ দিতে হবে। এর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে।
এ অবস্থায় সার্চ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল সার্চ কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৫ কার্যদিবসের প্রয়োজন হবে না। এর আগেই সার্চ কমিটি তাদের কাজ গুছিয়ে আনবে। এই কমিটির সুপারিশ করা ১০ জনের মধ্য থেকেই একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন ইসি গঠনের বেলায় ২০১২ ও ২০১৭ সালের পদ্ধতিই অনুসরণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ সিইসি ছাড়া এবারও চার নির্বাচন কমিশনার পদে প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এবং একজন নারী নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’জনের নাম সুপারিশ করবে।
অবশ্য এই কমিটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক বিতর্ক ও সংশয়ের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাজ শুরু করেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হচ্ছে। সার্চ কমিটির কাজের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ) ও সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)।
২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি ইসি নিয়োগে গঠিত প্রথম সার্চ কমিটি সুপারিশ আকারে ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছিল। ওই সময়ে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচটি নাম পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সব মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নামের তালিকাও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চাওয়া হয়েছিল। একইভাবে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের নামের তালিকা কমিটিতে পাঠানোর আহ্বান করা হয়েছিল। এ ছাড়াও যোগ্য ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সার্চ কমিটির সদস্যদের। পরে সব নাম নিয়ে বৈঠকে বসে সার্চ কমিটি। তারপর চূড়ান্ত হয় সুপারিশ করা ১০ জনের নাম। একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল গত মেয়াদেও।
এর আগে দায়িত্বে ছিলেন যারা: স্বাধীনতার আগে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে ১১ জন সিইসি ও ২৩ নির্বাচন কমিশনার এ পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে সামরিক শাসনামলে একজন সিইসির মেয়াদ বাড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। প্রথম সিইসি মো. ইদ্রিসের পাঁচ বছর মেয়াদ ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই শেষ হলে পরদিনই নিয়োগ পান বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের শাসনামলে প্রায় আট বছর সিইসি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি তার মেয়াদ শেষের দিনে নিয়োগ পান বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসুদ।
এরপর বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি হন। তিনি ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এরপর বিচারপতি আবদুর রউফ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান। পরের কমিশনে সিইসি হন বিচারপতি এ কে এম সাদেক। এরপর পর্যায়ক্রমে সিইসি হন মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ ও বিচারপতি এম এ আজিজ। এম এ আজিজের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। ফলে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় কয়েক দফায় নিয়োগ পেয়ে একসঙ্গে সাতজন কমিশনার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারা একযোগে পদত্যাগ করেন। এরপর ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত হয় তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন। ওই সময়ে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং নির্বাচনী আইনে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কমিশন দায়িত্ব পালন করে। তখন পর্যন্ত কমিশনের সদস্য সংখ্যা কতজন হবে, তা নির্দিষ্ট ছিল না। পরে সংবিধান সংশোধন করে সিইসিসহ কমিশনের সদস্য সংখ্যা পাঁচজনে নির্দিষ্ট করা হয়।