গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাশের দাবিতে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছে। ওই সময় শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলেন। এছাড়া বকশীবাজার এবং নীলক্ষেত মোড়েও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। হাফ পাশ কার্যকর এবং গণপরিবহণে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপনের জন্য সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে তারা বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) আবারও রাস্তায় নামবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে হাফ পাশ নিশ্চিতের দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করেন। বাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার দাবিতে তারা স্লোগান দিতে থাকেন।
দুপুর দেড়টার দিকে তারা ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে অবরোধ কর্মসূচি শেষ করে মিছিলের প্রস্তুতি নেন। এমন সময় ঢাকা কলেজের দিক থেকে ৫০-৬০ জন তরুণ লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। কিছুক্ষণ ধাওয়া-পালটা ধাওয়া চলার পর শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে সরে যান। তাদের অভিযোগ, হামলার আগে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে রাস্তার পাশে থাকা একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের অভিযোগ তুলে তর্ক বাঁধান।
কথা কাটাকাটির মধ্যেই লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা করা হয়। এ হামলার সময় রাস্তায় স্কুল-কলেজের পোশাক পরা সব শিক্ষার্থীকেই মারধর করা হয়। শিক্ষার্র্থীদের অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতে আইডিয়াল কলেজের এক ছাত্রকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার প্রায় ৫ ঘণ্টা পর ওই ছাত্রকে মুক্ত করে আনা হয়েছে।
ডিএমপির রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ মাহমুদ মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের মোটরসাইকেল ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমরা দুপক্ষকেই শান্ত করে নিজ নিজ কলেজে পাঠিয়ে দিয়েছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি জানান, আইডিয়াল কলেজের প্রতিনিধি দল ঢাকা কলেজে গিয়ে কথা বলে ওই ছাত্রকে মুক্ত করে এনেছে।
পুলিশের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই ছাত্রকে মুক্ত করতে সোমবার বিকালে আইডিয়াল কলেজের ১১ শিক্ষকের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আইকে সেলিম উল্লাহ খন্দকারের সঙ্গে দেখা করে। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও ছিলেন। দুপক্ষের মধ্যে কথাবার্তা বলে সমঝোতার মাধ্যমে ওই ছাত্রকে ফিরিয়ে আনা হয়। আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জসিমউদ্দীন আহমেদ সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে জানিয়েছেন, তারা ছাত্রটিকে ফিরিয়ে এনেছেন।
এর আগে ধানমন্ডি থানার পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের কিছু শিক্ষার্থীর বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। পরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তিনি জানান-শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে মিরপুর সড়ক, ধানমন্ডি, নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। সেখানে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শিক্ষার্থীরা অন্য যানবাহন ছেড়ে দিলেও কিছু বাস আটকে স্প্রে ও মার্কার দিয়ে তাদের দাবি ও বিভিন্ন স্লোগান লিখে দিচ্ছিলেন। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে তারা ওই এলাকা প্রদক্ষিণ করছিলেন। পরে আন্দোলনকারীরা রাস্তা থেকে সরে গেলে পুলিশ দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাস্তা চলাচলের জন্য খুলে দেয়।
এদিকে শিক্ষার্থীদের হাফ পাশ নিশ্চিতের দাবিতে মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১১টায় বকশীবাজার মোড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচি থেকে সাত কলেজ আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ইসমাঈল সম্রাট বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাশের জন্য প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে ২৫ নভেম্বর সকাল ১০টায় রাজধানীর নীলক্ষেতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।
তিনি বলেন, গণপরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে দেশের শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের মাথায় বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। যে পরিবারে একাধিক শিক্ষার্থী বা সন্তান রয়েছে, তাদের বাবা-মা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ, টিফিন খরচ, যাতায়াত ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাস্তবতা বুঝে সরকারকে দ্রুত শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও গণপরিবহণে ছাত্রী ও নারীদের যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হবে। তাদের নিরপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে আট ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের হাফ পাশের প্রজ্ঞাপন জারির ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোর দাবিতে রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনসহ ৮টি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে এ সমাবেশ করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি টিএসসি ঘুরে নীলক্ষেতে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মাসুদ রানার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন-বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবীর, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মিখা পেরেগু, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সায়েদুল হক নিশান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দপ্তর সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি তৌফিকা প্রিয়া। নীলক্ষেত মোড়ে দেড় ঘণ্টা ধরে সমাবেশ চলে। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল সায়েন্স ল্যাব মোড়, কাঁটাবন, শাহবাগ মোড় ঘুরে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, সরকার পরিবহণ খাতের সামগ্রিক নৈরাজ্য জারি রেখে ভাড়া বৃদ্ধির বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। পরিবহণ খাতের মাফিয়া এবং চাঁদাবাজের দৌরাত্ম্য ঠেকানোর কোনো পদক্ষেপ সরকারের নেই। আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করলেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করা হয় না। এগুলো সরকারের গণবিরোধী চরিত্রের বহির্প্রকাশ।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার বলেন, অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের হাফ পাশের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। প্রজ্ঞাপন জারি করলে ছাত্রদের সঙ্গে পরিবহণ শ্রমিকদের অকারণ বাগবিতণ্ডা তর্ক-বিতর্ক, মারামারি বন্ধ হবে। শহরের গণপরিবহণে কোনো সিটিং সার্ভিস চলবে না। ওয়েবিল চেকিংয়ের নামে বাড়তি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করতে হবে, কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নিতে হবে। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা প্রসঙ্গে নেতারা জানান, শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকটি আন্দোলনে এবং যে কোনো গণআন্দোলনে ছাত্রলীগ চাপাতি, হেলমেট, হাতুড়ি, লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করে। ভোট ডাকাতির সরকারের যে কোনো গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ এবং পুলিশের ভূমিকা একই। আন্দোলনে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান ছাত্রনেতারা। নীলক্ষেত মোড়ে সমাবেশ থেকে সোমবার ২৯ নভেম্বর শাহবাগসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রতিমন্ত্রীর একাত্মতা : গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার দাবিতে চলা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান এমপি। মঙ্গলবার তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, চলমান আন্দোলন যৌক্তিক। ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলব। মঙ্গলবার প্রতিমন্ত্রীর তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
নগরজুড়ে ভোগান্তি : শিক্ষার্থীদের অবরোধে সৃষ্ট যানজটে ভোগান্তিতে পড়েন প্রয়োজনীয় কাজে বের হওয়া নগরবাসী। আকরাম হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি রাজধানীর শুক্রাবাদ এলাকা থেকে লালবাগ যাচ্ছিলেন জরুরি কাজে। দুপুর ২টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিল তার। কিন্তু তিনি দুপুর সাড়ে ১২টায় বাসা থেকে বের হয়েও সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি।
প্রতিবাদে ঢাবিতে মশাল মিছিল : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, গণপরিবহণে হাফ পাশের দাবিতে সিটি কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ ও উদয়ন কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল ও সমাবেশ করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে মিছিল শুরু করে ছাত্র অধিকার পরিষদ।
মশাল মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদীবের নেতৃত্বে এতে অংশ নেন পরিষদের শতাধিক নেতাকর্মী। সমাবেশে ছাত্র অধিকার পরিষদ সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ছাত্র। কিন্তু তাদের হাফ পাশ লাগে না। কারণ তাদের তথাকথিত বড় ভাইয়েরা বাস মালিকদের কাছ থেকে মাসিক মাসোহারা পান। বাস মালিকরা যদি হাফ পাশ চালু করেন তাহলে তাদের চাঁদার পরিমাণ কমে যাবে। আর তাই তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতেও দ্বিধাবোধ করেন না।