বিদেশে পাচার করা অর্থ ও সম্পদ দেশে অর্থনীতির মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অর্থ পাচারকারীদের সুযোগ দিয়েছিল সরকার। বলা হয়েছিল- নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধ করলে বিনা প্রশ্নে তারা পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে পারবেন। এ সুযোগ দেওয়ার পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো অর্থ দেশে আসেনি। ফলে আসছে বাজেটে এমন সুযোগ বাতিল করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।
পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনতে মাত্র ৭ শতাংশ করের মাধ্যমে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’র বিধান প্রথমবারের মতো অর্থ আইনে যুক্ত করা হয়েছিল। গত বাজেটে এমন ঘোষণার পরপরই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সিপিডিসহ সুশীল সমাজ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেও জানিয়েছিল সংস্থা দুটি।
এখন পর্যন্ত সেটিই সত্যি হয়েছে। যথাযথ সাড়া না পাওয়া এবং অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের চাপের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আসছে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে ওই সুযোগ বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ওই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে কোনো অর্থ দেশে আসেনি। অর্থাৎ পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার সুযোগ কেউ নিতে চাচ্ছে না বলেই প্রমাণিত হলো। অন্যদিকে এমন সুযোগ প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়। এসব বিবেচনায় আগামী বাজেটে এমন সুযোগ বাতিল করতে চায় সরকার। বাজেটে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেখা যাবে।
যদিও গত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ সুযোগে টাকা ফেরত আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সিপিডি বরাবরই এমন সুযোগ কাজে আসবে না বলে জানিয়েছিল।
এ বিষয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এর আগেও দেখা গেছে বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু খুব কমসংখ্যকই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছে। পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দেওয়ার সুযোগ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক তিনভাবেই অগ্রহণযোগ্য। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, টাকা যে ফেরত আসবে না সেটা সিপিডি থেকে আগেও বলা হয়েছে। এটা প্রমাণিত হয়েছে। যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, তাদের সম্পদ দেশেও রয়েছে। অনেক দেশ ট্যাক্স রিকোভারি পদ্ধতিতে পাচারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারে। আমরাও সেটা করে দেখতে পারি। পাশাপাশি অর্থপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’র বিধানের বিষয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বাজেটে বলা হয়েছিল, বিদেশে অবস্থিত যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ করা দিতে হবে। বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে কর আরোপ হবে। আর এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
এদিকে করজাল বিস্তারে আগামী অর্থবছর থেকে গ্রামাঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গ্রামের মানুষকে কর জালের আওতায় আনতে উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন জেলায় কর এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনও কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সাহায্য করবে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবটি আগামী ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটের অর্থ বিলে ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি) নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ইতোমধ্যে যার খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ট্যাক্স জিডিপি রেশিও কেন কম হচ্ছে, কোথায় লিকেজ হচ্ছে- এটার ওপর স্টাডি করা প্রয়োজন। জাতীয় সংসদ থেকে এটা আলোচনা হওয়া দরকার। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু আদায় হচ্ছে না। কোথায় লিকেজ এটা জানা দরকার। পরীক্ষামূলকভাবে কর এজেন্ট নিয়োগ করা উচিত। এ উদ্যোগ করদাতাদের সচেতন করবে।
আসন্ন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা; যা মোট জিডিপির প্রায় ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় এটি প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বিশাল আকারের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা; যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত এবং করবহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে আসন্ন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে আগামী বাজেটে। টাকার অংকে বাড়তি ৬০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরকে।
এছাড়া এনবিআরবহির্ভূত করের মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব খাত থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা আশা করছে সরকার।