ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় সরকারি অফিস ও থানায় তাণ্ডবের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি গতকাল রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য। অপর কমিটি তাণ্ডবের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য গ্রহণ করে।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আসলাম আলী মোল্যার নেতৃত্বে গঠিত ছয় সদস্যের এই তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন গণপূর্ত বিভাগের একজন উপসহকারী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। এই কমিটি ইউএনওর কার্যালয়, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়সহ দুটি সরকারি গাড়ি ও বাসভবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সবমিলিয়ে ওই ঘটনায় প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সেদিনের হামলায় ইউএনও ও এসিল্যান্ডের সরকারি যে দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তার মূল্য প্রায় এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া আসবাবপত্র, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, প্রকল্প কর্মকর্তার গুদামে রাখা খাদ্য সামগ্রীর হিসাবও রয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলায় তাদের প্রায় চার লাখ ২৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এক লাখ ২২ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোটরসাইকেল। এ ছাড়া থাই গ্লাস রয়েছে এক লাখ ২২ হাজার টাকার। এভাবে ইউএনওর কার্যালয়ের অন্যান্য দপ্তরেরও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে আলাদা আলাদা ভাবে। এদিকে, এই সহিংসতার কারণ, বিস্তার ও ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাসলীমা আলীকে প্রধান করে ৯ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। তাসলীমা জানান, রোববার দুপুরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অতুল সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ওই কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নিয়েছে। তবে তদন্তে কী উঠে এসেছে, তা জানাননি কমিটির প্রধান তাসলীমা আলী। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার তদন্ত প্রতিবেদন দুটি হস্তগত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এদিকে, সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ওই রাতের ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে ৫৪ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হলে ৪৮ জনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
গত ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজারে লকডাউনের কার্যকারিতা পরিদর্শনে যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি। এ সময় সহকারী কমিশনারের (এসিল্যান্ড) উপস্থিতিতে মানুষ ছোটাছুটি করে। পরে স্থানীয়রা জড়ো হয়। মানুষের ভিড় দেখে মারুফ সুলতানা ফুকরা বাজার থেকে চলে আসেন। পরে হেফাজতের এক আলেমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১ পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ উপজেলা চত্বরে দেশীয় অস্ত্র ঢাল-কাতরা ও লাঠিসোটা নিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও থানায় এই তাণ্ডব চালায়।
হামলাকারীরা তিন ঘণ্টাব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি উপজেলা পরিষদ চত্বরের গাছপালা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও। এতে সালথা উপজেলা সদর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তাণ্ডব চলাকালে ইউএনও-এসিল্যান্ডের দুটি সরকারি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সাংবাদিকের একটি মোটরসাইকেলসহ তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয় এবং দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫৮৮ রাউন্ড শটগানের গুলি, ৩২টি টিয়ার গ্যাসের শেল, ২২টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৭৫টি রাইফেলের গুলি ছুড়ে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৬১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১৬ হাজার ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।