বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে ও সেগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। দেশ ও জনগণের তথ্যগত নিরাপত্তা দিতে সরব হয়ে উঠছে বিভিন্ন দেশের সরকারেরা। যার মধ্যে আছে বাংলাদেশও। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়নের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। এমনই প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে জবাবদিহিতা ও আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে আইন তৈরি করার পথে হাটছে বাংলাদেশও।
বিভিন্ন দেশের আইন
আইন প্রণয়ন করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে বিশ্বের অনেক দেশই। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, তুরস্ক, কানাডা, রাশিয়া এবং ভারত সম্প্রতি এ বিষয়ে আইন পাস করেছে। এছাড়া সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক জোট হিসেবে জিডিপিআর (তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা) করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এর আলোকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের তথ্য-উপাত্ত যদি ফেসবুক-গুগল ব্যবহার করতে চায়, অবশ্যই তাদেরকে স্থানীয়ভাবে ডাটা সেন্টার স্থাপন করতে হবে।
নতুন আইন কার্যকর করেছে রাশিয়া ১ জুলাই থেকে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য। সেই আইনে রাশিয়া বলছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেশটিতে ইন্টারনেট কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হলে সেখানে অবশ্যই তাদের শাখা কিংবা অফিস থাকতে হবে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া ফেসবুক, গুগল এবং ইয়াহুর মতো টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি আইন পাস করে। এই আইনের আলোকে এসব প্ল্যাটফর্মে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আর তা থেকে প্ল্যাটফর্মগুলো কোনো মুনাফা আয় করে থাকলে তার লভ্যাংশ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকেও।
এছাড়া গেল ২৬ মে ভারত আইটি রুলস ২০২১ কার্যকর করে (লিংক- https://banglanews24.com/information-technology/news/bd/864070.details)। এই বিধিমালার আওতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে আর মাধ্যমগুলো সরকারের দেওয়া বিধি ও শর্ত না মানলে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে। অর্থাৎ অপরাধের জন্য সরাসরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বিবাদী পক্ষ করে মামলা রুজু করার সুযোগ রাখা হয়েছে সেই আইনে। এছাড়া এই আইনের অধীনে ৫০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী আছে এমন কিছু প্ল্যাটফর্মের জন্য আরও কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। এগুলোর মধ্যে ভারতে একজন অভিযোগ গ্রহণ করার কর্মকর্তা, একজন নোডাল অফিসার এবং একটি চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার নিয়োগ করা এবং নিয়োগকৃতদের ভারতের বাসিন্দা হওয়ার মতো শর্ত অন্যতম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইন
উল্লেখিত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এমন একটি আইন প্রণয়নের কথা ভাবছে সরকার। আর এমনটি দরকার বলেও মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ব্যারিষ্টার আহমদ ইহসানুল কবীর বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে নানা রকম আইন বিরোধী কাজের মাধ্যম হিসেবে। যেমন, নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো, গুজব ছড়িয়ে জনসাধারনদের বিভ্রান্ত করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে নিরীহ মানুষদের বাড়ি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, অশালীন ছবি প্রচার, আর্থিক অনিয়ম ও প্রতারণা, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কর্তৃক তরুণ-তরুণীদের সংগ্রহ করা ইত্যাদি। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা পেটেন্ট ও কপিরাইট লঙ্ঘন করে বিভিন্ন তথ্য, সংবাদ, চিত্র ও ভিডিও একে অন্যদের সাথে বিনিময় করে থাকে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিনষ্টে নানা অসত্য তথ্য প্রচার করা হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই বিষয়গুলো প্রতিহত করার জন্য এবং লঙ্ঘনকারীদের আইনের আওতায় আনতে সাম্প্রতিক আইটি রুলস ২০২১ ভারত সরকার প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আইনে কনটেন্ট ফিল্টারিং করার ব্যবস্থা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট বা আইডি খুলতে জাতীয় পরিচয় পত্র বা মোবাইল নম্বর বাধ্যতামূলক করা, দেশেই সার্ভার স্থাপন করার মতো বিধান রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যারিস্টার ইহসানুল কবীর বলেন, শিশু পর্নোগ্রাফি, অশালীন স্থিরচিত্র ও ভিডিও, আর্থিক প্রতারণা, জুয়া, সন্ত্রাসমূলক কাজ প্রতিহত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ সফটওয়্যার তৈরি করে ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করে, যাতে ব্যবহারকারীরা নিরাপদ থাকতে পারে, তার জন্য আইনে বিধান রাখা যেতে পারে।