আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিক দফতরের শীর্ষ পদে থেকে অনেকটা দুই হাতে টাকা কামানোর অভিযোগ ছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে। বদলি থেকে শুরু করে কেনাকাটা, উন্নয়ন কাজে অর্থ লোপাট করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। সরকারের ঘনিষ্ঠভাজন পরিচয় দিয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে দাপট দেখাতেন। যে কারণে নিগ্রহের শিকার হয়েও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেননি অন্য সহকর্মীরা। অবশেষে আর শেষ রক্ষা হয়নি ক্ষমতাধর এই আমলার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেলেও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হয়েছে শাহ কামালকে।
রোববার (১৮ আগস্ট) সকালে মহাখালীর একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতারের আগেরদিন তার মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে জব্দ করা হয় ৩ কোটি ১ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা। যে টাকা গুনতে লেগেছিল মেশিন। জব্দ করা পরিমাণ আরও টাকা বাসা থেকে আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে এমন অভিযোগও আছে।
জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও অঢেল সম্পদ অর্জনের তথ্য দিয়ে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছিল, যা নিয়ে দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধান শুরু করলেও দৃশ্যমান কিছুই হয়নি।
ডিবি পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, শাহ কামাল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মহাখালীতে একটি বাসায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে কালো গ্লাসের একটি গাড়ি রাখা ছিল।
শাহ কামালের বাসা থেকে বিপুল নগদ টাকা জব্দের পর সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে ফলাও করে এই তথ্য প্রচারের পর তার পরিচিত, সহকর্মীদের মধ্যেও কেউ কেউ শাহ কামালের সম্পদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।
শাহ কামালের সঙ্গে কাজ করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার তার অপকর্মের কথা জানিয়ে সম্প্রতি খোলা চিঠি দিয়েছেন। নিজেও তার হাতে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
একসময় কিশোরগঞ্জে দায়িত্ব পালন করা শাহ কামালের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও কথা বলেছিলেন বলে দাবি করেছেন আউয়াল মজুমদার। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে গাজীপুরে কর্মরত থাকাবস্থায় জনতার মঞ্চের সঙ্গে শাহ কামাল সরাসরি জড়িত ছিলেন এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
কে এই শাহ কামাল?
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে জন্ম নেয়া শাহ কামাল পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপসচিব, জেলা প্রশাসক, পর্যায়ক্রমে সরকারের সিনিয়র সচিব হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রাথমিক সরকারের সিনিয়র সচিব হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র (প্রশাসক) এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র (প্রশাসক) হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন বলেও জানা গেছে।
শাহ কামাল, বাংলাদেশ খো খো ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার (সিএনসি) পদেও নির্বাচিত হয়েছেন।
শাহ কামালের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
শাহ কামাল ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। এ দায়িত্বে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে বদলি, কেনাকাটা, উন্নয়নকাজসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধ অর্থগ্রহণের অভিযোগ ছিল।
এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তার নামে মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৯টি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল। তিনি এসব গাড়ির ভুয়া বিল-ভাউচারে সরকারি কোষাগার থেকে টাকাও তুলতেন।
দুদকে দায়ের করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, শাহ কামাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থেকে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্প (যা দেশব্যাপী ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রকল্প নামে পরিচিত), গ্রামীণ সড়কে ছোট-বড় সেতু কালভার্ট নির্মাণ, এইচবিবি, বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প থেকে এই অর্থ লোপাট করেছেন। যদিও অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া তদন্তকাজ বেশি দূর যায়নি।
এদিকে প্রশাসন ক্যাডারে শাহ কামালের হাতে নিপীড়নের শিকার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে ৮৪ব্যাচের এই কর্মকর্তা সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দুর্নীতিতেও গেছেন সবাইকে ছাড়িয়ে। যে কারণে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়া নিয়ে এক সময় গুঞ্জন থাকলেও দুর্নীতির কারণে ছিটকে পড়েন তিনি৷
শুধু তাই নয়, প্রভাবের কারণে সিনিয়র সচিবের মতো পদ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগও করেছেন তার সঙ্গে চাকরি করা কর্মকর্তারা।
শাহ কামালকে উদ্দেশ্য করে সাবেক সচিব আউয়াল মজুমদার লিখেছেন, ‘যদি নিয়মমাফিক সবকিছু হতো, আপনি কী উপসচিবের বেশি ওপরে উঠতে পারতেন! কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে সিনিয়র সচিব হলেন। তারপরও শোকর আদায় করলেন না। উপরোন্তু সিনিয়র-জুনিয়র সকল সহকর্মীর ওপর নির্মম নিপীড়ন চালালেন।’