সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি বিচারপতি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। নানা কারণে সমালোচিত মানিক সবশেষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে নারী উপস্থাপিকার সঙ্গে অশোভন আচরণ করে আবার আলোচনায় আসেন। ওই অনুষ্ঠানে নারী উপস্থাপিকাকে রাজাকারের বাচ্চা বলেও সম্বোধন করেন। আবার যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা সংস্কার চায় সেসব শিক্ষার্থীরাও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক বিচারপতি।
শুধু টক শোর ঘটনাই নয়, দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে নানা কাজে বিতর্ক তৈরি করেছেন তিনি। আর এসব বিতর্কের কারণেই তিনি এতো পরিচিত।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে যান ক্ষমতাসীন দলটির সব এমনপি-মন্ত্রীরা। গা ঢাকা দেন অনেক বিচারক ও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্মাও। তাদের মতোই নিখোঁজ হয়ে যান সাবেক বিচারপতি মানিকও। অবশেষে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বৃহস্পতিবার রাতে বিজিবি’র হাতে আটক হয়েছেন তিনি। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে আটক করে বিজিবি।
আটক করার পর তাকে বিজিবি ক্যাম্পে হেফাজতে রেখে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরবর্তীতে তাকে রাত ১২টা নাগাদ ক্যাম্প থেকে থানার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
সাবেক বিচারপতি মানিককে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নাজিম উদ্দিন। নাজিম উদ্দিন বলেন, গতরাতে এক ব্যক্তি তাকে টেলিফোন করে জানান যে অপরিচিত একজন লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাচ্ছে। তখন বিষয়টি স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।
বিজিবি’র জিজ্ঞাসাবাদে কী ছিল?
নাজিম উদ্দিন এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিচারপতি মানিক যে স্থান থেকে আটক হয়েছিলেন, ওই জায়গাটায় পাহাড়ি জঙ্গল আছে। ভারতীয় সীমান্তে খাসিয়াদের গ্রাম।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে আধা কিলোমিটারের মতো এলাকায় জঙ্গল রয়েছে। খাসিয়াদের গ্রাম পার হলেই বড় সড়কের দেখা মেলে।
একজন ব্যক্তির পালানোর খবরে বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন তিনি কলাপাতার ওপর শুয়ে আছেন। এরপর তাকে ধরে কিছু প্রশ্ন করেন বিজিবি সদস্যরা। সেইসব জিজ্ঞাসাবাদের কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে।
বিবিসি ওই ভিডিওগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখেছে যে সেগুলো গতকাল রাতেরই। ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বিজিবি সদস্য তাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
উত্তরে তিনি বলেন যে মুন্সিগঞ্জ। এরপর নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক।’ তখনই ওই বিজিবি সদস্যকে বিদ্রুপ করে বলতে শোনা যায়, ‘বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক? ওই মানিককা… যে কয়দিন আগে চ্যানেল আইতে এক উপস্থাপককে…ই…করছো…।’ তখন মানিক নিজেই বলেন সেই উপস্থাপকের কাছে তিনি পরে ক্ষমা চেয়েছেন। এরপর একপর্যায়ে তিনি তার বাবার নাম বলেন- মরহুম আব্দুল হাকিম চৌধুরী।
তার কাছে তখন জানতে চাওয়া হয় যে তিনি কেন ভারতে পালাচ্ছেন? তার উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভয়ে পালাইতেছি…প্রশাসনের ভয়ে।’
ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। পালানোর সময় তার সঙ্গে ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলাদেশি পাসপোর্ট, টাকা, কিছু ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ছিল। কিন্তু যাদের সহায়তায় তিনি পালাচ্ছিলেন, তারা তার কাছে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে এবং তাকে তারা ‘সীমান্তের ওপারে নিয়ে মেরেছে’ বলেও জানান তিনি।
মানিককে নিয়ে যত বিতর্ক
ছাত্র বিক্ষোভের সময় বেসকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর একটি টকশো গিয়ে এক নারী উপস্থাপকের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন মানিক। সেটি ভিডিও ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে পড়ে। মানিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িভাড়া পরিশোধ না করার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
নোটিশে বলা হয়, অবসরে যাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় রাজধানীর গুলশানে একটি সরকারি বাড়ি দখলে রেখেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরে ২০১৭ সালে তিনি বাড়িটি ছাড়লেও বাড়িভাড়া, গ্যাস ও পানি বিল বাবদ সরকারের পাওনা ১৪ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা এখনও পরিশোধ করেননি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। তিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার আইনজীবীও ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন।
বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন মানিককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। যে রায়টি কেন্দ্র করে মানিক সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন সেটি হচ্ছে, কর্নেল তাহের হত্যা মামলার রায়। সে রায়ে কর্নেল তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ হিসেবে বর্ণনা করেন মানিক। তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
২০১৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে একটি বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অভিশংসন চেয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। অবসরে যাবার কয়েকদিন আগে তিনি একাজ করেছিলেন।
বিচারপতি থাকা অবস্থায় বিমানের বিজনেস ক্লাসে সিট না পাওয়া নিয়ে মানিক লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিলেন। ২০১২ সালের শেষের দিকে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার জেরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি করেছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
পরে বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চারজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাইকোর্টে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমতা চেয়ে নিষ্কৃতি পান। চাকরি শেষে বাড়ি না ছেড়েও তিনি আলোচনায় এসেছিলেন।
২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৫ সালে অবসর গ্রহণের পরে আবারো তিনি লন্ডনে হামলার শিকার হন।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দ্বৈত নাগরিকত্ব নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পাশপাশি ব্রিটেনেরও নাগরিক।
২০১২ সালের জুন মাসে তৎকালীন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সমালোচনা করেছিলেন। আদালতে বসে মানিক তৎকালীন সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন।
এরপর মানিকের সমালোচনা করা হয় সংসদে। তাকে অপসারণের লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য তাঁরা প্রধান বিচারপতি এবং প্রেসিডেন্টকে তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
‘তিনি মানুষকে অপমান করতে পছন্দ করেন। যারা স্যাডিস্ট, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়, আমরা তাদের ঘৃণা করি।’বলেছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
তৎকালীন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে বলেছিলেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তাঁর পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।’
তোফায়ল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও রাশেদ খান মেনন শামসুদ্দিন চৌধুরীর মানিকের সমালোচনা করেছিলেন।
সংসদে এই সমালোচনার পরেও শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কোন অসুবিধা হয়নি। সংসদের সমালোচনার ছয়মাস পরেই তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১৩ সালে পদোন্নতি পান। সূত্র: বিবিসি বাংলা।