রাজধানীর পল্লবীতে ছেলের সামনে সাহিনুদ্দিন (৩৩)কে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার লক্ষ্মীপুরের সাবেক এমপি লায়ন এম এ আউয়ালের উত্থান হয়েছে জালিয়াতি, ভূমি দখল ও প্রতারণার মাধ্যমে বলে নির্বাচনী এলাকার লোকজন মনে করছেন। দশম সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে তিনি তরিকত ফেডারেশনের হয়ে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের প্রার্থী হন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর হেলিকপ্টার নিয়ে রামগঞ্জে আসেন। নিজের অবস্থান জানান দিতে ওইদিন হেলিকপ্টারে এসে তিনি ‘কারিশমা’ দেখিয়েছিলেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘একতরফা’ নির্বাচনে আউয়াল সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে তার জন্য কাজ করেছিল। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রামগঞ্জে এসে নিজের অবস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হয়রানি, সরকারি বরাদ্দ লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ এখনো মানুষের মুখে-মুখে। তার অপকৌশল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীই মেনে নিতে পারেননি। এ জন্য অনেক নেতাকর্মীই হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আউয়াল ২০০৪ সালে হাভেলি প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে আবাসন কোম্পানির নিবন্ধন নেয়। ২০১০ সালে রাজধানীর মিরপুরের উত্তর কালশীর বাউনিয়া মৌজায় প্রায় ৪০ একর জমি নিয়ে হাভেলি গ্রুপ আলীনগর আবাসিক প্রকল্প শুরু করে। আউয়ালের বিরুদ্ধে ঢাকার মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় জালিয়াতির মাধ্যমে জমি দখল করে আবাসিক প্রকল্প বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। প্লট কিনে অনেকে এখনো মালিকানা বুঝে পাননি। জমির মালিকানা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে। যিনি প্রতিবাদ করেছেন, তাকেই হামলা-মামলার আসামিসহ হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
২০১৫ সালের ১৪ মে ঢাকায় মিরপুরে একটি জমি দখল নিয়ে এমপি থাকাকালীন আউয়ালের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের হাতে কলেজছাত্র আবদুর রহমান চঞ্চল খুন হয়। এটি বুঝতে পেরে অনেকেই তার থেকে দূরে ছিল। এতে বিভিন্ন সময় নানাভাবে ওই নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার আসামিসহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রামগঞ্জে তরিকত ফেডারেশনের কোনো নেতাকর্মী ছিল না। ২০১৩ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে জোটগত মনোনয়ন পাওয়ার আগে নির্বাচনী এলাকা রামগঞ্জে আউয়ালকে লোকজন তেমন চিনতেন না। তিনি মনোনয়ন পেয়ে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর দুপুরে হেলিকপ্টারে এলাকায় আসে এবং বিকেলেই হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরে যান। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আউয়ালকে নির্বাচনী বিভিন্ন সময় অন্তত ৩০টি সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১ মার্চ উপজেলার ইছাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শ্রীরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক সংর্বধনা অনুষ্ঠানে তাকে প্রায় ৭ ভরি ওজনের সোনার নৌকা উপহার দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে তখন আউয়াল সমালোচিত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুইজন সিনিয়র নেতা জানান, ভূমি দস্যুতার মাধ্যমে আউয়াল টাকার পাহাড় গড়েছেন। প্রতারণা করে অনেককেই নিঃস্ব করে দিয়েছেন। প্রতারণার মাধ্যমেই তার উত্থান হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে তাদের হয়রানি করত। এমপি পদ ব্যবহার করে তিনি প্রতরণার ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। রামগঞ্জে আশানুরূপ কোন উন্নয়ন করেনি। উল্টো প্রতিনিধির মাধ্যমে সব কাজ থেকে কমিশন হাতিয়ে নিতেন।
উল্লেখ্য, ১৬ মে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ৩১ নম্বর রোডে সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে বিকেলে সুমন ও টিটু জমির বিরোধ মেটানোর কথা বলে সাহিনুদ্দিনকে ফোন করে ডেকে নেয়। সাহিনুদ্দিন মোটরসাইকেলে পল্লবীর ডি-ব্লকের ৩১ নম্বর সড়কের ৪০ নম্বর বাসার সামনে পৌঁছালে সহযোগীদের নিয়ে সুমন ও টিটু তাকে টেনে-হিঁচড়ে ওই বাড়ির গ্যারেজে নিয়ে যান। এ সময় সাহিনুদ্দিনের ছেলে মাশরাফি গেটের বাইরে ছিল।
গ্যারেজে ঢুকিয়ে তাকে (সাহিনুদ্দিন) চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তারা। এরপর তাকে ওই বাড়ি থেকে বের করে ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে নিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। কোপানোর একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। নিহতের মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে পরিকল্পনাকারী হিসেবে এম এ আউয়ালকে প্রধান করে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে সাবেক এমপি আউয়ালকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।