সাক্ষীর অভাবে মাদকের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সমন দিলেও হাজির হচ্ছেন না সাক্ষীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ায় ভুক্তভোগীরা পরে আর সাক্ষ্য দিতে চান না। শুধু তাই নয়, সাক্ষী থাকলেও তদন্তকালে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অনেকেই সাক্ষ্য দিতে ভয় পান। সাক্ষীর অভাবে দেশের বিভিন্ন আদালতে মাদক অপরাধ মামলার বিচার হচ্ছে না। মামলার জটও কমছে না। অন্যদিকে. আইনের ফাঁক গলে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন এসব মামলার আসামিরা। এদের কেউ কেউ পুনরায় মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। এদিকে, প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় নতুন নতুন মাদক মামলা হচ্ছে। ফলে মামলার তালিকাও বাড়ছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মামলার জট কমিয়ে বিচার নিষ্পত্তি করতে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটি অভিমত প্রকাশ করেছে যে, দুই মন্ত্রণালয়কে (আইন এবং স্বরাষ্ট্র ) সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। দুই মন্ত্রণালয় সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে। সম্প্রতি লকডাউন শেষ হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। মাদক মামলাগুলো কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বর্তমানে সারাদেশে বিচারাধীন মোট ১১ লাখ ৭১ হাজার মামলা। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ মাদক অপরাধের মামলা। সম্প্রতি আরও লক্ষাধিক নতুন মাদক অপরাধ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় সোয়া লাখ আসামি থাকলেও অধিকাংশ আসামিই পলাতক। সম্প্রতি পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান বেড়েছে। এ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। যদিও বিচারের গতি তেমন বাড়ছে না।
১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রদ করে ২০১৮ সালে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’ নামে নতুন আইন পাস করে সরকার। আইনের ৪৪ ধারায় মাদক সংক্রান্ত অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু সীমাবদ্ধতা থাকায় এখনও ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও প্রতিদিনই নতুন মামলা যুক্ত হচ্ছে।
দুই বছর আগে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল, ‘ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫(২) ধারা অনুযায়ী অন্যান্য আইনের অধীনে অপরাধ বিধান অনুযায়ী মাদক মামলাগুলো প্রচলিত আদালতেই বিচার হবে।’ ওই নির্দেশনায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ওসি ও সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সাক্ষী হাজির করে মামলা নিষ্পত্তিতে সহযোগিতা করতেও বলা হয়। অভিমতসহ রায়ে আদালত সৃষ্ট পরিস্থিতিকে ‘অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও হতাশাজনক’ বলে উল্লেখ করেন।
রায়ে এই অভিমত দেওয়া হয় যে, ‘যেহেতু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৪, অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল গঠন কিংবা জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজকে ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার বিধানটি এখনও কার্যকর হয়নি, সেহেতু বিচার প্রক্রিয়ায় শূন্যতা পূরণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫(২) ধারা এক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য ও কার্যকারিতা পাবে।’ এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুলল্গাহ আবু বলেন, বেশিরভাগ মামলাই সাক্ষীর জন্য নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষীকে উপস্থিত করতে পারেন না। তাই সাক্ষী হাজির করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া অনেক মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়নি। তদন্ত শেষ করে দ্রুত চার্জশিট জমা দিতে হবে। আলাদা ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি, তাই অতিরিক্ত কোর্টে মামলা নিষ্পত্তি হবে। সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসেবে তিনিও চান মাদক মামলার নিষ্পত্তি হোক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মৃত্যুদ, যাবজ্জীবন কারাদ বা পাঁচ বছরের বেশি সময়ের সাজার বিধান যে আইনে থাকে, সেক্ষেত্রে দায়রা আদালত বিচার করবেন। পরোয়ানা ইস্যু করতে পারবেন মহানগর হাকিম। তবে দুই বছরের কম সাজার ক্ষেত্রে বিচারিক হাকিমও বিচার করতে পারবেন। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মাদক মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়াও মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্যোগী হতে হবে। আসল দোষীকে সাজা দিতে হবে। না হলে মাদকের কার্যক্রম চলবেই। রাষ্ট্রপক্ষ উদ্যোগী না হলে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হবে। সার্বিক বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের নজর দিতে হবে।’