‘না মাইরা হাত ভাইঙ্গা দিতো, নাইলে একখান পা ভাঙতো। তা না করে গুল্লি করে ওরা আমরা তরতাজা নাতিডারে মাইরা লইলো। কি করে মরলো নাতিডা..? মনে হয় কইতরের মতো দাপাইলো।’
এভাবেই নিহত নাতির জন্য আহাজারি করছিলেন মুন্সিগঞ্জের যুবদলকর্মী শহিদুল ইসলাম সাওনের (২৭) দাদি ষাটোর্ধ্ব হালিমা বিবি।
প্রিয় নাতিকে হারিয়ে শোকে কাতর তিনি। হালিমা বিবি বলেন, ‘আমি কই যামু, আমার নাতিডারে তো আর পামু না। সাওনরে তো আর পামু না বাবা।’
বিচার চান কি না এমন প্রশ্নে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। বলেন, ‘এগুলো কইয়া কী হইবো? বিচার তো পামু না। ঈমাণে যদি লয়, তাইলে বিচার করবো। কী বিচার করবো, সাওনরে তো আইনা দিতে পারবো না।’
বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন সাওন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ওইদিন রাতেই ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয় তাকে। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টা ৪৮ মিনিটে সেখানে মারা যান সাওন।
তবে হাসপাতাল থেকে স্বজনরা মরদেহ বুঝে পেতে দেরি হওয়ায় এখনো নাতির অপেক্ষায় সাওনের দাদি ষাটোর্ধ্ব হালিমা বিবি। ক্ষণে ক্ষণে নাতির স্মৃতি হাতড়ে ফিরছেন। সঙ্গে শেষবার নাতির মুখটা দেখার অপেক্ষায় এ বৃদ্ধা। সাওনের স্ত্রী, সৎ মা, বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সিগঞ্জ মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা এলাকায় নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন. বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে যান সাওন। কিছুক্ষণ পরই পরিবারের লোকজন খবর পান সাওন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
সেই কথায় বার বার আওড়াচ্ছেন সাওনের মা লিপি বেগম। তিনি বলেন, ‘পোলাডা আমার কাছে ভাত চাইলো। আমি তাড়াতাড়ি দিলাম। ও খেয়ে গেলো। ওই যে গেলো, আর আইলো না। একটু পর হুনি গুলি আমার সাওনের গুলি লাগছে। কালকে (বৃহস্পতিবার) রাতে খবর আইলো, পোলাডা আর নাই। ওরা আমার পোলাডারে এমন করে কেন মারলো?’
লিপি বেগম বলেন, ‘অটোরিকশা চালাতো সাওন। ডেইলি আনে, ডেইলি খাই। এখন আমাগো কে দেইখবো?’
স্বামীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ সাওনের স্ত্রী সাদিয়া। বার বার অচেতন হয়ে পড়ছেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাদিয়া বলেন, ‘আমার ছেলেটার বয়স ৮ মাস। ওর এখন কী হবে? আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের বিচার চাই।’
সাওন সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা গ্রামের ছোয়াব আলী ভূইয়ার ছেলে। চার ভাই ও একবোনের মধ্যে সাওন সবার বড়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমও ছিলেন এ যুবক।
বিএনপির মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেও সাওনের রাজনীতিসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তেমন জানতো না পরিবার। মিছিল-সমাবেশে তার অংশ নেওয়ার বিষয়েও তেমন জানাশোনা ছিল না তাদের। তবে সাওনের বন্ধু ও পরিচিতজনরা তার রাজনীতিতে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতেন। মাঝেমধ্যে যুবদল ও বিএনপির মিছিল-সমাবেশে অংশ নেওয়ার কথাও তারা জানেন।
এদিকে, এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ছিল নিহত সাওন। প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সাওন কারও সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করেছেন- এমনটি তারা কখনো শোনেননি। এলাকায় ভদ্র ও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। যা আয়-রোজগার করতেন, তা দিয়ে বাবা-মাসহ পরিবার নিয়ে কোনোরকম জীবনযাপন করতেন।
বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মুন্সিগঞ্জে বিএনপির বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে মুক্তারপুরের ফেরিঘাট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ চলে।
সংঘর্ষে পুলিশের এএসপি, সদর থানার ওসিসহ ১০ সদস্য আহত হন। এছাড়া বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহের সময় আহত হন তিন সাংবাদিকও।
সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় যুবদলকর্মী সাওন ও জাহাঙ্গীর নামের আরেকজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাওনের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে এ ঘটনায় পুলিশ ও শ্রমিক লীগের এক নেতা বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন। দুই মামলায় ৩৬৫ জনের নাম উল্লেখ করে এক হাজার ৩৬৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে বিএনপির অন্তত ২৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।