প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কারাবন্দী রোজিনা ইসলাম মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকবেন নারী সাংবাদিকেরা। রোজিনা ইসলামের জামিনে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং গণমাধ্যমবিরোধী কালাকানুন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা। শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) প্রাঙ্গণে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে ক্ষুব্ধ নারী সাংবাদিকেরা প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত এবং সাংবাদিক সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়া নারী সাংবাদিকেরা এসব কথা বলেছেন। এ কর্মসূচিতে প্রথম আলো পরিবারের সদস্যরা সংহতি জানান। এ ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত পুরুষ সাংবাদিকেরাও কর্মসূচিতে অংশ নেন।
নারী সাংবাদিকেরা বলেন, ঘটনার পর থেকে কারও চোখেই ঘুম নেই। নারী সাংবাদিকেরা ঘটনার দিন থেকেই পথে আন্দোলন করছেন। রোজিনা ইসলামের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা মাঠে থাকবেন। রোজিনা ইসলাম এমন কোনো অপরাধ করেননি যে তাঁকে কারাগারে রাখতে হবে। তাঁকে রোববার মুক্তি দেওয়া না হলে কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তা–ও বন্ধের দাবি জানান তাঁরা।বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা কর্মসূচিতে নারী সাংবাদিকেরা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে ‘আমার বোন রোজিনা, মুক্তি ছাড়া বুঝি না’, ‘সাংবাদিক জেলে কেন, প্রশাসন জবাব চাই,’ ‘প্রশাসনের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও,’ ‘দুর্নীতিবাজের আস্তানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
রোজিনাকে কেন কারাগারে পাঠানো হলো
কর্মসূচিতে সাংবাদিক নেতা শাহনাজ শারমীন কিসের জন্য রোজিনা ইসলামকে কারাগারে পাঠানো হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে রোজিনা ইসলামের করা প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার নজির নেই, বরং যিনি প্রতিবেদনগুলো করলেন, তাঁকেই জেলে পাঠানো হলো।
নারী সাংবাদিকেরা বলেন, রোজিনা ইসলাম ভুক্তভোগী, আসলে চেপে ধরা হয়েছে সাংবাদিকতাকে। সচিবালয়ে অবরুদ্ধ ঘরে রোজিনা ইসলাম ছিলেন একা, আর তাঁর চারপাশে ছিল প্রশাসনের অনেক লোক। রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করার ঘটনা রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধী। আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে রোজিনা ইসলামের জামিন পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।
সাংবাদিকের জায়গা কারাগার হতে পারে না
সাংবাদিকনেতা শামীমা দোলা বলেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শেখাতে চাচ্ছেন। প্রেস রিলিজ ছেপে দেওয়াই কি সাংবাদিকতা? তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা সরকার বা বিরোধী দলের বন্ধুও না, শত্রুও না। সঠিক সংবাদ তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকের জায়গা কারাগার হতে পারে না।
যারা দুর্নীতি করছে, অপরাধী তারা
ডিআরইউর বর্তমান নারীবিষয়ক সম্পাদক রীতা নাহার বলেন, ‘রোজিনার শুধু জামিন নয়, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং এ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির পর আমরা বাড়ি ফিরব। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে বলছি, রোজিনা ইসলামকে আর এক দিনও কারাগারে দেখতে চাই না। যারা দুর্নীতি করছে, অপরাধী তারা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।’
দাগি আসামি জামিন পায়
সাংবাদিক দৌলত আক্তার গত সোমবার ঘটনার দিন সচিবালয়ে রোজিনা ইসলামের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, রোজিনা অসুস্থ ছিলেন। রোজিনাকে হাসপাতালে নেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়। রোজিনা ইসলাম কী এমন অপরাধ করেছেন? দাগি আসামি জামিন পায় আর রোজিনার জামিন হলো না। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান দৌলত আক্তার।
প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে
প্রথম আলো পরিবারের পক্ষে প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রোজিনা ইসলামের সঙ্গে প্রতিটি ঘটনায় প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
সাজ্জাদ শরিফ বলেন, সাংবাদিকদের ঐক্য বজায় রাখতে হবে। সংবিধানে বাক্স্বাধীনতা এবং আলাদাভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। অনেকগুলো আইন সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করেছে। সাংবাদিকেরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়গুলো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। সংবিধানের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য কালো আইনগুলো তুলে নেওয়া এবং প্রত্যাহার করা হোক। রোজিনার মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি এ কালো আইন বাতিলের দাবিতেও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এ ঘটনা কি আসলেই বাংলাদেশে ঘটতে পারে
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক নারী সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখনই তো যে কেউ আপনাকে বা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। কোনো একটা জেলখানায় থাকলেন। এটা হলো জুলুমের লক্ষণ। যে সংহতি জানাতে এসেছি, তা বোনের জন্য, এমনকি আমাদের নিজেদের জন্যও। বৃহত্তর কারণে এসেছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এসেছি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি।’ আনিসুল হক বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিককে হয়রানি ও জুলুম করা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করার যে চক্রান্ত চলছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশের সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মানবাধিকার, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, জাতিসংঘসহ পৃথিবীব্যাপী এই যে ঐক্য, তা শুধু একজন রোজিনার মুক্তির দাবিতে নয়, তা বৃহত্তর সংগ্রাম, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
রোজিনা ইসলামের প্রিজনভ্যানের ছবিতে যে চাহনি, তাতে অসহায়ত্ব এবং অবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, চোখের চাহনি বলছে, এ ঘটনা কি আসলেই বাংলাদেশে ঘটতে পারে? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সাইমন ড্রিং, অগ্রগণ্য সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদসহ বিখ্যাত সাংবাদিকদের ঝুঁকি নিয়ে করা কাজগুলোর কথা উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, মানুষের স্বার্থে, মানুষের মুক্তির জন্য সাংবাদিকেরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যখন সাংবাদিকেরা ভূমিকা পালন করেন, তখন তা মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করে।
ঐক্য ধরে রাখতে হবে
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, রোজিনাকে আটক রাখার সময় থেকে এ পর্যন্ত তাঁর মুক্তিতে নারী সাংবাদিকেরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এই ঐক্য ধরে রাখতে হবে। একসঙ্গে চলতে হবে। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সোহরাব হাসান বলেন, ‘সাংবাদিকতার ঐক্য চাই। সবাই সরকারের দুর্নীতি-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে সরকার যে স্বৈরাচারী আচরণ করছে, তা করতে সাহস পেত না। রোববার রোজিনা ইসলাম জামিন পাবেন বলে আশা করছি। না পেলে কঠিন সংগ্রামে যেতে হবে। সেখানে প্রথম আলো পরিবার সবার পাশে আছে।’
ডিআরইউর সাবেক নারীবিষয়ক সম্পাদক সাজিদা ইসলাম বলেন, ‘শুধুমাত্র রোজিনা ইসলামের মুক্তি নয়, তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং যারা তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।’ প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে সাংবাদিকনেতা নাসিমুন আরা হক, পুলক ঘটক, এম এম জসীম, প্রথম আলোর প্রতিবেদক রিয়াদুল করিম, ডিআরইউর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য রুমানা জামান, সাংবাদিক শরিফা বুলবুল, নজরুল ইসলাম, রাজনীন ফারজানা, ফারহানা তাহের, ফাহিমা আক্তার, ফারজানা প্রিয়দর্শিনী, আসমা আক্তার, নার্গিস জুঁই, মরিয়ম মনি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সদস্য কাজী সুফিয়া আখতার প্রমুখ সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।