নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম কালবেলাকে বলেন, ‘জাহাজটি বাংলাদেশের পতাকাবাহী এবং এটি বাংলাদেশের সম্পদ। তাই সেটি উদ্ধার করতে গিয়ে সংঘাত বা প্রাণহানি হতে পারে—এমন অভিযান চালানোর সুযোগ কারও নেই। আমরা সেই অনুমতিও কাউকে দিইনি।
জাহাজটি উদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও জাহাজ মালিকপক্ষ সূত্র জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত জলদস্যুরা কোনো দাবি বা চাহিদার কথা জানায়নি। তবে জিম্মি নাবিকদের মাধ্যমেই দস্যুদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা চলছে। কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, দস্যুরা সহসাই তাদের দাবি-দাওয়া জানাতে পারে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ২৩ বাংলাদেশি নাবিককে সুস্থ উদ্ধারের জন্য সরকার নানা কৌশলে এগোচ্ছে।
গতকাল বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য নাবিকদের সুস্থভাবে মুক্ত করা। একই সঙ্গে জাহাজ মুক্ত করা। আমরা নানা কৌশলে এগোচ্ছি। আমরা আশা করি, একটা সমাধানে যেতে পারব।’
নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও জাহাজটির মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, গতকাল সকাল পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া এমভি আব্দুল্লাহ সোমালিয়ার গদবজিরান উপকূলের মাত্র দেড় নটিক্যাল মাইল (এক নটিক্যাল মাইলে ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার) দূরে নোঙর করা হয়েছে। এলাকাটি সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জাহাজে জিম্মি নাবিকরা সুস্থ রয়েছেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। সর্বশেষ সোমবারও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। নাবিকদের অনেকেই এখন নিজ নিজ কেবিনে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। কয়েকজনকে আবার ব্রিজে (যেখান থেকে জাহাজ চালানো হয়) একসঙ্গে রাখা হয়েছে।
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে এমভি আব্দুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কয়েক দফা অবস্থান পরিবর্তন করে।
যেভাবে চলছে উদ্ধার প্রক্রিয়া:
এমভি আব্দুল্লাহ দস্যুর কবলে পড়ার পর নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহলকে জানানো হয়েছে। এরপর জাহাজটির দিকে নজর রাখার কথা জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স-ইইউএনএভিএফওআর। ‘অপারেশন আটলান্টা’ হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে আসা সংস্থাটির সদস্যদের সঙ্গে জলদস্যুদের গুলি বিনিময়েরও খবর বের হয়। এরপর এমভি আব্দুল্লাহর সহায়তায় ভারতের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ এবং একটি দূরবর্তী টহল জাহাজ মোতায়েন করার তথ্য আসে। সর্বশেষ এমভি আব্দুল্লাহ এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানায় দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের মুক্ত করতে অভিযানের এ পরিকল্পনা করেছেন।
সোমালিয়ার পান্টল্যান্ড এলাকার পুলিশ বাহিনী বলেছে, এমভি আব্দুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘জিম্মি নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে এ ধরনের অভিযানে সরকার ও জাহাজ মালিকপক্ষ রাজি নয়। আমরা আমাদের আগের অবস্থানে রয়েছি। নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় মুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নাবিকদের মুক্ত ও জাহাজ উদ্ধারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সেক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। জাহাজে থাকা জিম্মি নাবিকদের মাধ্যমেই জলদস্যুদের সঙ্গে একটা আলোচনা চালানোর চেষ্টা চলছে।
সূত্র জানায়, এর আগেও কবির গ্রুপের জাহাজ জাহানমণি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। দীর্ঘদিন পর নাবিকদের মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের মুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, তারা শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, হয়তো শিগগিরই দস্যুরা তাদের মোটিভ জানাবে।
জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে জিম্মি নাবিকদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাদের জীবনের হুমকি হতে পারে—এমন যে কোনো সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান। সরকার সহিংস যে কোনো অভিযান পরিচালার বিপক্ষে। এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে হামলা হলে আমাদের নাবিকদের প্রাণহানির শঙ্কা থেকে যায়। সুতরাং আমাদের কোম্পানি ওই পথে হাঁটবে না। আমরা নাবিকদের জীবিত অবস্থায় স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।’
কয়লা দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত জাহাজটি:
জলদস্যুদের জিম্মায় থাকা জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল গোলাগুলি হলে বা নির্দিষ্ট সময়ের পর এসব কয়লায় আগুন ধরে গেলে বড় ধরনের প্রাণহানি হবে। সেই আশঙ্কা এখন আর নেই বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।
সংস্থাটির মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম কালবেলাকে জানান, তারা নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছেন জিম্মি অবস্থায় পুরো জাহাজে নিরাপত্তা চেক করার সুযোগ নাবিকরা পেয়েছেন। জাহাজটি পুরো নিরাপদ রয়েছে।
তিনি বলেন, কয়লা নিয়ে যে শঙ্কাটা ছিল, সেটা এখন পর্যন্ত নেই। কারণ নাবিকরা ও জাহাজে থাকা প্রকৌশলীরা সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়েছেন।
ফুরিয়ে আসছে খাবার:
স্বজনরা জিম্মি নাবিকদের উদ্ধৃত করে বলছেন, নাবিকদের সঙ্গে খাবার ও পানিতে ভাগ বসিয়েছে দস্যুরা। ফলে জাহাজে মজুত নির্ধারিত খাবার ও পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পানি ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে দস্যুরা। পুরো দিনে মাত্র দুই-এক ঘণ্টা পানি ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে নাবিকদের। বাকি সময়ে পানি নিয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে সাগর থেকে। এখন যে খাবার ও পানি মজুত আছে, তা ১০ থেকে ১২ দিন চলতে পারে। এগুলো ফুরিয়ে গেলে কী হবে, তা নিয়ে স্বজনের কাছে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন জিম্মি নাবিকরা।
জানা গেছে, খাবার ও পানি পাঠাতে কেনিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সাহায্য চেয়েছে জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ। বীমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে তারা। বীমা প্রতিষ্ঠান আবার মাধ্যম হিসেবে খুঁজছে মধ্যস্থতাকারী কোনো পক্ষকে; যাদের সঙ্গে জলদস্যুদের যোগাযোগ আছে। জলদস্যুদের কেউ এ ব্যাপারে কথা বলছে না। তাই উৎকণ্ঠা বাড়ছে স্বজনের মাঝে।
জাহাজের মালিকপক্ষের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম বলেন, এখন জাহাজে যে খাবার ও পানি আছে, তা বেশি দিন যাবে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে জলদস্যুরা অনেক সময় উপকূল থেকে এনে প্রয়োজন মেটায়। তার পরও আমরা বিকল্প পথে এগোচ্ছি। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে খাবার ও পানির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।
ওই জাহাজে জিম্মি রয়েছেন অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। তার ভগ্নিপতি বদরুল ইসলাম জানান, সোমালিয়ার সিম কার্ড দেওয়ার কথা বলে তাদের সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে দস্যুরা। তবে তারা কোনো সিম দেয়নি।
বদরুল আরও বলেন, ‘ফোনে শামসুদ্দিন বলেছেন, দস্যুরা চাচ্ছে মালিকপক্ষ নিজ থেকে তাদের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করুক। তাহলে মুক্তিপণের অর্থ বেশি করে নিতে পারবে। অন্যদিকে জাহাজ মালিক চাচ্ছে, দস্যুরা তাদের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করে দাবি-দাওয়া বলুক।’