বৈরী আবহাওয়া, সারের দাম বৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ে কারণে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এছাড়া আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। এই অবস্থায় সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত জুনে দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশে। যা বিগত আট বছরে সর্বোচ্চ। এ কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সেই সঙ্গে মজুরি সূচক ও মূল্যস্ফীতি প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে আয়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চড়া দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়ে ভোক্তারা এখন নিজেদের ব্যয় কমাচ্ছে।
সরকারি হিসাবেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। খোদ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলেছে, গত বছরের ১ আগস্ট থেকে চলতি বছরের একই তারিখ পর্যন্ত এক বছরে নিত্যব্যবহার্য গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি পণ্যের দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, আলু, গুঁড়া দুধ, গরুর গোশত, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, চিনি, শুকনা মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, জিরা ইত্যাদির দাম কয়েকগুণ বেড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দামামায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দার ওপরে। এক বছরে ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে প্যাকেটজাত আটার বর্তমান দাম ৫০ টাকায় উঠেছে। একই অবস্থা ময়দার ক্ষেত্রে। গত বছরের ৪৫ টাকা কেজি ময়দা প্রায় ৫২ শতাংশ বেড়ে বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬২২ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত।
সম্প্রতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা মহামারি থেকে ঘুরে না দাঁড়াতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে যে মন্দা দেখা দিয়েছে, সে বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, ঝড়ঝাপ্টা আমাদের আছেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, এগুলো আমাদের সবসময় মোকাবেলা করতে হয়, করতে হবে। সেটা আমরা করতে পারব। যতক্ষণ জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে, আমাদের চিন্তার কিছু নেই। জনগণই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি।
সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। যেভাবে আমরা করোনা মোকাবেলা করেছি, ঠিক একইভাবে যুদ্ধের (রাশিয়া-ইউক্রেন) সময় যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে, যে ভয়াবহতা দেখা দিচ্ছে, এটা থেকেও আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, খাদ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করেছে। আরও তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল আমদানির চেষ্টা চলছে। সরকারের হাতে এখন ১৮ লাখ ৮৩ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। তার মধ্যে ১৭ লাখ ৮০ হাজার টন চাল রয়েছে। কিন্তু এবার বোরোর ফলন কম হয়েছে। আমনের ফলনেও আশানুরূপ চাল না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থায় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার চাল আমদানিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানা যায়, বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকেই সবচেয়ে বেশি ৫৫ শতাংশ চাল আসে। আর আমন ধান থেকে আসে ৩৯ শতাংশ চাল। বাকিটা আউশ থেকে আসে। এবার প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে আমন চাষ কমেছে। বিগত আউশ মৌসুমেও ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। আর আসন্ন বোরো নিয়ে চিন্তা রয়ে গেছে। আর চলতি আমন ও আসন্ন বোরোর উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবহাওয়ার চরম বৈরী আচরণে এবার আমন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষক জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য সময়মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, বেড়েছে ডিজেলের দাম। কৃষকদের এমন বৈরী পরিস্থিতি মুখোমুখি হওয়ার কারণে আসন্ন বোরো মৌসুমেও ধান চাষে ভাটা পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেচ-সারের অভাব ও বাড়তি খরচায় কৃষকরা অনাগ্রহী হতে পারে। ডিজেলের বর্তমান দাম বহাল থাকলে আসন্ন বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়বে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানা যায়, সরকার জিটুজি পদ্ধতিতে ভিয়েতনাম থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে। তার মধ্যে দুই লাখ টন সেদ্ধ চাল আর ৩০ হাজার টন আতপ। ভিয়েতনাম ওই দুই লাখ টন সেদ্ধ চাল থাইল্যান্ড থেকে কিনে বাংলাদেশে সরবরাহ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে তিন কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন হবে। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন ১২ লাখ টন কমতে পারে।
তাছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি সেচযন্ত্র ছিল। তার মধ্যে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৭টি সেচযন্ত্র ডিজেলে চলেছে। অর্থাৎ ডিজেলে চলে প্রায় ৭৮.৪৩ শতাংশ সেচযন্ত্র। তার পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র এবং পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার বেশি। ওই হিসাবে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে নয় লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৯ টন। ওই তেল কিনতে কৃষককে খরচ করতে হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। নতুন দামে আগামী বোরো মৌসুমে একই পরিমাণ ডিজেল ব্যবহৃত হলে কৃষককে গুনতে হবে ১১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। ফলে সেচ, পরিবহন আর কৃষিযন্ত্র পরিচালন করতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে তিন হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। তাছাড়া ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ায় চলতি আমন ও পরবর্তী বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদনে কৃষকের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যা ও অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর আউশ ও আমন ধানের আবাদ গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম উৎপাদন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। বিদেশ থেকে চাল আমদানিনির্ভরতাও একই সাথে আরও বাড়বে। দেশের মোট চালের চাহিদার প্রায় ৫৫ শতাংশ আসে বোরো ধান থেকে। আর বাকি ৪৫ শতাংশ আসে আউশ ও আমন ধান থেকে। এর মধ্যে আমন থেকে আসে ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ চাল। আউশ থেকে আসে ৬ থেকে ৭ শতাংশ।
কৃষি অর্থনীতিবিদ গোলাম হাফিজ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা ও অতি খরাই এবার আউশ ও আমনে ফলন কম হবে। তাই খাদ্য মজুদের ওপর চাপ বাড়বে। আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। যেহেতু চালের দাম বেড়ে গেছে তাই চালের বিকল্প হিসেবে এগুলোতে জোর দিতে হবে। অন্যদিকে, আগামী বোরো মৌসুমকে গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে। কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার ও ডিজেলের দাম কমিয়ে দিতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে প্রায় ১৮ লাখ টন বেশি ধান, চাল এবং গমের মজুদ আছে। এজন্য দুর্ভিক্ষ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সারা পৃথিবীর মানুষ একটা শঙ্কার মধ্যে আছে। সারা পৃথিবীর মানুষ উদ্বিগ্ন, একটা ব্যাপক মন্দা হতে পারে সারা পৃথিবীতে, খাদ্য সংকট। সারা পৃথিবী হলে আমরা তো আলাদা নয়। আমরা তো গম বিদেশ থেকে আনি। তাই সজাগ ও সচেতন থাকতে প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক বার্তা সকলের জন্য। সাধারণ নাগরিকদেরও আমরা সচেতন করছি।