সরকারঘোষিত ২৮টি প্রণোদনার মাধ্যমে সাত কোটি ২৯ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ উপকৃত হয়েছেন। পাশাপাশি সুবিধা পেয়েছে এক লাখ ৭২ হাজার প্রতিষ্ঠান। বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমন তথ্য জানান।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় আমি এই প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়নে একটি সংক্ষিপ্ত হালচিত্র তুলে ধরেছিলাম। আজ এই মহান সংসদে আমি প্যাকেজগুলোর সফল বাস্তবায়নের ফলে দেশের জনগণ যে উপকৃত হয়েছেন তার চিত্রসহ করোনার প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র তুলে ধরছি। তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে বেতন-ভাতা বাবদ সরকার যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল সরবরাহ করেছে তা হতে সরাসরি উপকৃত হয়েছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের ৩৮ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী, যার ৫৩ শতাংশই নারী।’
মুস্তফা কামাল বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে আমাদের দেওয়া ৭৩ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা এবং একইভাবে কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রদত্ত ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল হতে এখন পর্যন্ত সুবিধা গ্রহণ করেছে চার হাজার ৫২৯টি বৃহৎ এবং এক লাখ ৫৩ হাজার ৮৬১টি কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম ও এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম হতে সুবিধা ভোগ করেছে ছোট-বড় অসংখ্য ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান।
‘সরকারের এসব প্যাকেজের ফলেই আজ রপ্তানিমুখী শিল্পসহ অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাত পুরোপুরি উৎপাদনে ফিরে এসেছে।’
তিনি বলেন, ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া প্রায় এক কোটি ৩৯ লাখ দরিদ্র ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য আমরা খাবারের ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি, নিম্ন আয়ের ৭০ লাখ ৫৭ হাজার পরিবারের মাঝে সরকার মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করেছে। অতিমারির সময় অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সারাদেশে প্রথম পর্যায়ে নির্বাচিত ৩৫ লাখ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ২৭ লাখ উপকারভোগী পরিবারের প্রত্যেককে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা প্রদান করেছি। আমরা দেশের অতি দরিদ্র মোট ২৬২টি উপজেলায় বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচির আওতা শতভাগে উন্নীত করেছি। দেশের সকল প্রতিবন্ধীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এনেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে গৃহহীন মানুষের জন্য সারাদেশে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ২৩৩টি গৃহনির্মাণের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি দরিদ্র মানুষের নিরাপদ ও সম্মানজনক বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছি। অতিমারির সময় আমাদের সরকারের নেওয়া এসব সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রমের ফলে দেশের লাখ লাখ মানুষ অতিমারির অভিঘাত হতে সুরক্ষিত থেকেছে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার ঘোষিত প্যাকেজের বাস্তবায়নের ফলে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষিপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা গেছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রয়েছে। কৃষি প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে উপকৃত হয়েছে দেশের এক কোটি ৬৫ লাখ কৃষক পরিবার। কৃষকের ঋণপ্রাপ্তি সহজ করার লক্ষ্যে গঠন করা আট হাজার কোটি টাকার কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে এখন পর্যন্ত সুবিধা পেয়েছে তিন লাখ ১৪ হাজার কৃষি ফার্ম। নিম্ন-আয়ের পেশাজীবী কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত তিন হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের সুবিধা ভোগ করেছেন এখন পর্যন্ত ৫.৩৪ লাখ নিম্ন-আয়ের পেশাজীবী কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে কর্মসৃজনের মাধ্যমে চাঙা করতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের ঋণদান প্যাকেজসমূহের উপকারভোগী হয়েছেন লাখ লাখ গ্রামীণ জনগণ। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোপুরি সচল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গৃহীত এসব সময়োপযোগী পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরূপ কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রীকে কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলায় সফল শীর্ষ নারীনেত্রীদের অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় ব্যয়ের বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যেখানে বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অনুদানসহ ঘাটতি থাকবে দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বেশি।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের আয়ের খাতগুলো থেকে কর বাবদ তিন লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা আয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরে এনবিআরকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর ছাড়া আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি। বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা।