তার নাম রেজাউল আলম শাহীন। বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বাটিকামারী জোনারংক গ্রামে। কোনোমতে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন। করেন না চাকরিও। কিন্তু দেড় দশকের মধ্য পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’। গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। ১৫ বছর আগে টিনের ঘরে থাকলেও এখন গ্রামে বানিয়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। বনে গেছেন অঢেল সম্পদের মালিক।
বোন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা শিউলি ও দুলাভাই সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
নিজের নামে ঢাকায় অন্তত সাতটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। স্ত্রীর নামে কিনেছেন বাড়ি। অথচ তিনি ব্যবসা করেন কি না সে সম্পর্কে এলাকাবাসীর ধারণা না থাকলেও শাহীন ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত বলে কেউ কেউ তথ্য দিয়েছেন।
শাহীনের সম্পর্কে জানতে বেশ কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হলেও তারা নিজেদের পরিচয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নামপরিচয় না দিয়ে অনেকে জানান, শাহীন বেশিরভাগ সময় ঢাকা বা অন্যত্র থাকেন। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে যান। বোন আর দুলাভাইয়ের দাপট দেখিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন এমন খবর এলাকার অনেকেই জানেন।
গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানান, দেশ স্বাধীনের পর তাদের সম্পত্তি তেমন একটা ছিল না। কিন্তু গত ১৫ বছরে তারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
এলাকার প্রবীণ এক ব্যক্তি বলেন, ১৫ বছর আগে শাহীনদের টিনের ঘর ছিল। এখন সেটা পাল্টে বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি করেছেন। এছাড়া অনেক সম্পদও করেছেন। ঢাকায় নামে-বেনামে তাদের নানা ব্যবসা আছে। তবে প্রকাশ্যে ঠিকাদারী ব্যবসা করেন। তার ঠিকাদারী ব্যবসার নাম এসএস এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া তার দায়িত্বে দুটি আন্তর্জাতিক এনজিও রয়েছে। সেগুলো হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিফিল (কেএসআর) এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল।
জানা যায়, শাহীনের বাবা সাদেক মিয়ার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তার মেয়ে শিউলি বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে। শিউলি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত তার চাকরির পরই তার এক ভাই ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন। দুই বোনকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। শিউলির স্বামী মনিরুল ইসলাম। তিনি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন।
শাহীনের যত সম্পদ
অনুসন্ধানে জানা যায়, শাহীনের ঠিকাদারী ব্যবসার নাম এসএস এন্টারপ্রাইজ। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়েই আবার কেএসআর-শারজাহ ইন্টারন্যাশনালের সব নির্মাণ কাজ করানো হয়। এ ছাড়া এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) থেকেও লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তাই সেখানকারও তালিকাভুক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে রেজাউল আলম শাহীনের নামে মিরপুরের রাকিন সিটি ও পুলিশ কনভেনশন সংলগ্ন আড়াই কাঠার একটা বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। মিরপুর ডিওএইচএস সংলগ্ন ৬ কাঠার প্লট, উত্তরাতে ৬ কাঠার ২টি প্লট, (এর সঙ্গেই লাগোয়া পাশাপাশি শাহীনের এনজিও কেএসআরের ডিজি গাজী জহিরুল ইসলামেরও ২টি প্লট আছে)। করোনাকালে দুইজনে চারটি প্লট একসঙ্গে নিয়েছেন।
ফরিদপুর শহরে শাহীনের ১৫ কাঠা জমি আছে। সাভারের ধউর ব্রিজ পার হয়ে (জিরাবোর দিকে যেতে) ডান দিকে ভেতরের একটা রাস্তা দিয়ে বেশ সামনে কয়েক একর জমি আছে, যার অধিকাংশ দখলকৃত। গাজীপুরে শাহীন ও গাজী জহিরুল আলমের একসঙ্গে ৩/৪ একর জমি থাকার খবরও পাওয়া গেছে। তবে তা পুরোপুরো যাছাই করা সম্ভব হয়নি।
মিরপুরের পল্লবীতে একই ভবনে শাহীনের ১৮০০ স্কয়ার ফিটের মোট তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ঠিকানা: বাড়ি ১১, রোড-১৮ অ্যাভিনিউ-৫, সেকশন-১১, পল্লবী, মিরপুর। একটি ফ্ল্যাট শাহীনের স্ত্রী তানজিন টুম্পার নামে রেজিস্ট্রেশন করা। এসব সম্পদের অধিকাংশই মনিরুল ইসলামের বলে গোপন সূত্রে জানা যায়। এছাড়া মিরপুর-১০ বাড়ি-১০, রোড ২২, ব্লক সিতে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
শাহীন দুটি এনজিও চালান। এগুলোতে বিপুল আন্তর্জাতিক অনুদানের তথ্যও মিলেছে। এনজিও দুটি হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিফিল (কেএসআর) যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৬৫১ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৮২৫। দুটি এনজিও-ই হাউস-০২, রোড ০৬/এ, সেক্টর-০৪, উত্তরা, ঢাকা: ১২৩০ ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা। সামনে থেকে এনজিও দুটির পরিচালনায় অন্য ব্যক্তিরা থাকলেও সরকারি নথি ও দাপ্তরিক কার্যাবলিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে শাহীনের নামই ব্যবহার করা হয়েছে।
কেএসআরের পাওয়া অনুদানের একটি হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এনজিওটিতে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৫২৪ মার্কিন ডলার অনুদান আসে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৪৬৬ কোটি ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ১৪৯ টাকা (১১ আগস্টের মুদ্রা বিনিময় হিসাবে)। তবে এনজিওটির ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট হিসাব বের করা যায়নি। যদিও এনজিওটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেশের ৮০০ গ্রামে তারা ৫০০ মসজিদ নির্মাণ, ১০০ এতিমখানা, ১০০০ হাজার ওজুখানা নির্মাণ করেছে।
শুধু কুয়েতভিত্তিক এই এনজিওটিই নয়, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল এনজিও কীভাবে তার হাতে এলো তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল—দুটি এনজিওয়ের যত নির্মাণ কাজ হয় তার দায়িত্বে থাকে শাহীনেরই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এসএস এন্টারপ্রাইজ। এসব ব্যাপারে শাহীনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।