গত ১৬ মে জমি সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জেরে সন্তানের সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাজধানীর পল্লবীর স্থানীয় বাসিন্দা সাহিনুদ্দীনকে। পরে হত্যাকারী মো. সুমন বেপারী লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান মো. আউয়ালের মোবাইলে কল করে বলেন, ‘স্যার ফিনিশ’।
এ ঘটনার পর আউয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সুমনসহ বাকিরা গা ঢাকা দেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। গতকাল বুধবার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী সাবেক এমপি আউয়ালসহ তিনজনকে ভৈরব, চাঁদপুর ও পটুয়াখালী থেকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেফতার হওয়া বাকি দুজন হলেন মো. হাসান ও জহিরুল ইসলাম বাবু।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) বিকেল সাড়ে ৪টায় কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত ১৬ মে রাজধানীর পল্লবীতে নিজ সন্তানের সামনে সাহিনুদ্দীনকে সন্ত্রাসীরা চাপাতি, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ১৭ মে নিহতের মা মোসা. আকলিমা রাজধানীর পল্লবী থানায় ২০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলা হওয়ার পর থেকে র্যাব এ ঘটনায় ছায়া তদন্ত শুরু করে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। পরে র্যাবের অভিযানে এই তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব সদরদফতর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর একটি দল বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হাসানকে গ্রেফতার করে। একই রাতে ভৈরব থেকে মো. আউয়াল এবং ভোরে পটুয়াখালী থেকে জহিরুল ইসলাম বাবুকে গ্রেফতার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। ঘটনার চার থেকে পাঁচ দিন আগে সাবেক এমপি আউয়ালের কলাবাগান অফিসে আসামি তাহের (এজাহারে ২ নম্বর আসামি) ও সুমন (এজাহারের ৩ নম্বর আসামি) হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। মাঠ পর্যায়ে হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য সুমনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সুমনের নেতৃত্বে প্রায় ১০-১২ জন সক্রিয়ভাবে কিলিং মিশনে অংশ নেয়। তাদের সহযোগী হিসেবে আরও বেশ কয়েকজন ছিল।
তিনি বলেন, ১৫ মে সুমন, বাবুসহ কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকজন পরামর্শ করেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা সুমনের নেতৃত্বে ১৬ মে বিকেলে ঘটনাস্থলে জড়ো হন। সাহিনুদ্দীন সন্তানসহ সেখানে উপস্থিত হলে সুমন, মনির, মানিক, হাসান, ইকবাল ও মুরাদসহ ১০-১২ জন ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, এরপর সাহিনুদ্দিনের শরীরের উপরের অংশ এবং হাঁটু ও হাত-পায়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে মনির ও মানিক। ওই সময়ে বাবুসহ বেশ কয়েকজন আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে লুকআউট ম্যান হিসেবে নজরদারি করে। হত্যাকাণ্ডটি পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে সংঘটিত হয়। ঘটনা শেষে সুমন হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আউয়ালকে মোবাইলে ফোন করে জানায়, ‘স্যার ফিনিশ’। তাদের আরও অল্প কিছুক্ষণ কথা হয়। এরপর হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতরা দেশের বিভিন্ন স্থানে গা ঢাকা দেয়।
আউয়াল সাহিনুদ্দীনকে কেন হত্যা করিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হত্যাকারী সুমন আউয়ালের বিভিন্ন ব্যবসা, জমি দখলের সঙ্গে জড়িত ছিল। আউয়ালের সঙ্গে সাহিনুদ্দীনের জমি নিয়ে যখন বনিবনা হচ্ছিল না, তখন সুমনসহ আউয়ালের অন্য অনুসারীরা একটি সাহিনুদ্দীনকে মেরে ফেলতে বলে। সাহিনুদ্দীনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ হত্যাকাণ্ডে ৩০ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আউয়াল ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা শিকার করেছেন। সাহিনুদ্দীনকে সাতটি কোপ দিয়েছে হাসান। এলাকায় সুমনের ডান হাত হিসেবে পরিচিত সে (হাসান)। আউয়াল যে প্রকল্পটি করেছেন সেখানে সাহিনুদ্দীনের পরিবারের সঙ্গে আউয়ালের ২০০৪ সাল থেকে জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। আউয়ালের আলীনগর প্রকল্পে সাহিনুদ্দীনের বেশ কিছু জমি রয়েছে। নিহত সাহিনুদ্দীন আউয়ালকে তার জমি দিতে রাজি হননি। তাছাড়া এ জমি দেওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘদিন বনিবনা হচ্ছিল না।
তিনি আরও বলেন, মো. আউয়াল একজন আবাসন ও জমি ব্যবসায়ী। তার ছত্রছায়ায় সুমন সন্ত্রাসী গ্রুপ দিয়ে জমিদখল ও আধিপত্য বিস্তার করত। আওয়ালের কাছ থেকে তারা মাস ভিত্তিক ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মাসোয়ারা পেত এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাজ অনুয়ায়ী অতিরিক্ত টাকা পেত। সন্ত্রাসী সুমন এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, রিকশা টোকেন বাণিজ্য, মাদক, জুয়াসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাত। তাকে এবং অপর আসামি রকি তালুকদারকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ, মিরপুর।