নাম আব্দুল কাদের মাঝি। শিক্ষাগত যোগ্যতা ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ তিনি প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত। নিজেকে কখনো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবার কখনো স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীর নিয়োগপ্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিয়মিত প্রতারণা করে আসছিলেন। এছাড়া সরকার পরিচালিত বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন তিনি। সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতেন। এভাবে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন আব্দুল কাদের।
প্রতারণা করতে তিনি রাজধানীর গুলশানের জব্বার টাওয়ারে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি কার্যালয় ভাড়া নিয়ে নিজের অফিস বানিয়েছিলেন। এছাড়া কাওরান বাজারে তার রয়েছে আরেকটি কার্যালয়। তিনি মিরপুর ৬ নম্বরে থাকেন। গুলশান ও মিরপুরে তার একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে। তবে শেষ রক্ষা তার হয়নি। সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর কাওরান বাজার, মিরপুর ও গুলশান থেকে প্রতারক কাদেরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরা বিভাগ।
গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেন, প্রতারক কাদেরের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, কাদেরের সততা প্রপার্টিজের ম্যানেজার শহিদুল আলম ও অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান। অভিযানে কাদেরের মিরপুরের বাসা থেকে মন্ত্রণালয়ের স্টিকার যুক্ত প্রাডো গাড়ি ও অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড ও তার কোমরে থাকা একটি অবৈধ বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও এক রাউন্ড গুলিসহ প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার। শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত আব্দুল কাদেরের গাজীপুরের বোর্ডবাজারে নয় তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ি ও পূবাইলে ৮ বিঘা জমিতে একটি বাগান বাড়ি রয়েছে। ঢাকায় আব্দুল কাদের অতিরিক্ত সচিব সেজে কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়িতে চড়েন। গাড়ির সামনে-পেছনে কাঁচে লাগানো বাংলাদেশ সচিবালয় স্টিকার এবং ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড। তিনি বিভিন্ন মানুষকে কোটি টাকার ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়া ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিলেন। মূলত দীর্ঘ ১৪ বছর ধরেই এসব প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি, চাপাবাজি করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন এই প্রতারক।
অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, আব্দুল কাদের গুলশান এক নম্বরের জব্বার টাওয়ারের প্রায় ৬ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি অফিসে বসতেন। স্টিকার যুক্ত গাড়িতে করে তিনি প্রায় সচিবালয়ে ঢুকতেন। অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ডাচ বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকাও রয়েছে। ঠিকাদার জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রতারক আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন।
এখন গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করা অসুবিধা হওয়ায় তিনি নিজেই অস্ত্র এবং ওয়াকিটকি নিয়ে চলাফেরা করতেন। প্রতারক কাদেরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা ট্রেড কর্পোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রোপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মটর্স ইত্যাদি।প্রতারক কাদের বড় রকমের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে।
২০০৪-২০০৬ সালে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি এবং খামার তৈরির নামে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এছাড়াও সততা প্রপার্টিজের নামে তিনি জমি এবং স্থাপনা কেনার জন্য নামমাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করে যেগুলো দিয়ে পরবর্তীতে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করে টাকা আদায় করে থাকেন।
হাফিজ আক্তার বলেন, প্রতারক আব্দুল কাদের নিজেকে স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীর নিয়োগপ্রাপ্ত লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে দাবি করেন। এ পরিচয় দিয়ে টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার না বলে চাকরিপ্রার্থী ও ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। আব্দুল কাদের ও তার স্ত্রী এবং তার সহযোগীদের নামে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণার, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলা রয়েছে।