বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সংস্কার ও বিচার নিশ্চিত করেই নির্বাচন দিতে হবে, তবে অতিরিক্ত সময় যেন না নেয় এই বিষয়ে লক্ষ্য রাখাতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচন এমনভাবে করতে হবে, যেন কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে।
বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) ইউরোপ ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে রাজধানীর একটি হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
জামায়াত আমির বলেন, সফরে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে। আমরা বলেছি, অনেক ত্যাগ ও চেষ্টার বিনিময়ে বাংলাদেশে যে পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের দাবি, তিনটা ম্যান্ডেটরি পরিবর্তন। প্রথমত : দৃশ্যমান গ্রহণযোগ্য মৌলিক সংস্কার। এই সংস্কার কীভাবে হবে তা আমরা কিছু বিষয় পরিষ্কার করেছি। আমাদের সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনা আমরা সংশ্লিষ্ট কমিশনে জমা দিয়েছি। আমরা বলেছি, এই মৌলিক সংস্কারগুলো না করে নির্বাচন হলে এই এই নির্বাচন গণতন্ত্রে কোনো ভিত্তি রচনা করতে পারবে না। কারণ অতীতে দেশ জাতির কাছে বিশ্বের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেরকম হয়ত আরেকটি খারাপ নির্বাচন হবে, আমরা ওই খারাপ নির্বাচন চাই না।
‘হাজার প্রাণের বিনিময়ে, হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব, আহত ও রক্তের বিনিময়ে পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের দাবি অবশ্যই সংস্কারাপন্ন করতে হবে। এই সংস্কার কারা করবে? এই সংস্কারের প্রধান অংশীদার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যত তাড়াতাড়ি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে, ততো তাড়াতাড়ি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে। এ সংস্কারের যদি সহযোগিতার ঘাটতি থাকে বা সহযোগিতা না করা হয় তাহলে দেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, দাবি; তাহলে সংস্কারের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা হোক, সেটি না হলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং এর দায় নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বাস্তবতার জায়গা থেকে জনপ্রত্যাশা পূরণে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংস্কারের সহযোগিতা করতে হবে।’
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত, যারা নিহত আহত হয়েছে। খুনের দায় যাদের, তাদের বিচারের আওতায় এনে দৃশ্যমান বিচার জাতিকে দেখাতে হবে। তাতে করে আস্থা ফিরে আসে যে খুনিদের বিচার হয়, অপরাধীদের বিচার হয়। শহীদ পরিবারগুলো যেন অন্তত স্বস্তি পায়, শহীদের আত্মা যেন প্রশান্তি পায় যে, এ দেশের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য আমরা দৃশ্যমান ন্যায়বিচার দেখতে চাই।
‘তৃতীয়ত, যেটা হতেই হবে, সেটা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পর শ্রদ্ধা করা সম্মান করা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমি জিতে গেলে নির্বাচন সুষ্ঠু, আর হেরে গেলে দুষ্ট এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে নির্বাচনটা এমন হতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। এজন্য এখন এখানে অনেক ডায়ালগ এর প্রয়োজন আছে। এটি সরকারের তরফ থেকে হতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে করতে পারে। সিভিল সোসাইটির অনেক দায়িত্ব আছে তারাও দেশ জাতির স্বার্থে করতে পারে। মাল্টিপল জায়গা থেকে এই চেষ্টা হলে তখন একটা পরিবেশ তৈরি হবে।’
জামায়াত আমির বলেন, এ সফরে তারা বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা জাতির সামনে বারবার বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা এই সময়টাকে আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির জন্য, সংস্কার ও বিচারের জন্য আমরা মনে করি এই সময়টা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই সময়ের সীমা যেন অতিক্রম না করে। সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখব।
বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ডেপুটি এসিস্ট্যান্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন জামায়াত। সেটার রেশ টেনেই জামায়াত আমির বলেন, আগামী রোজা শুরু হওয়ার আগে নির্বাচন হতে পারে ফেব্রুয়ারিতে। আমি আবারও বলছি, এটা তখনই হতে পারে যখনই শর্তগুলো পূরণ হবে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে কিন্তু ওই মার্চ বা ফেব্রুয়ারি ঠিক থাকবে কি না আল্লাহই জানেন।
তিনি বলেন, আমরা যারা খুব সিনসিয়ারলি, চাচ্ছি দেশে জনগণের গণতন্ত্র ফিরে আসুক, তাদের সবাইকে আন্তরিক সহযোগিতা এগিয়ে আসতে হবে আমরা প্রস্তুত। সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আমাদের দল, আমরা প্রস্তুত।
সফর প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, সম্প্রতি বেলজিয়ামে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল এবং বেলজিয়াম সরকারের বিভিন্ন কোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জামায়েতের একটি টিম সাক্ষাৎ করেছে। গত ৪ এপ্রিল এই সফর শুরু হয়। ব্রাসেলসে এই সফর আমরা শেষ করেছিলাম গত ১০ এপ্রিল। এরপর সেখান থেকে আমরা ইউকে(ইংল্যান্ড) যাই। ১৩ তারিখ আমি দেশে ফিরে আসি। এ সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন দলের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। লন্ডন থেকে আরও দুজন সহকর্মী আমাদের টিমে যোগদান করেন। তারা হলেন, আইনজীবী ও ইউরোপে আমাদের মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবু বকর সিদ্দিক মোল্লা ও ব্যারিস্টার মাহবুবুল আলম। এই সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন জামায়াত আমিরের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার প্রফেসর ড. মাহমুদুল হাসান চৌধুরী।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল, সভ্য, আধুনিক এই বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র ইউরোপের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করা। নতুন বাংলাদেশের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়া। অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাতে বিরামহীন চেষ্টা চালানো। আমি মনে করি এই সফর শুধু আমাদের জন্যই নয়, জাতির জন্য দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, একটি দায়িত্বশীল ইসলামী রাজনীতির দল হিসেবে মূল উপপাদ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ ও দেশের সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখা। এ সফরে আমরা ছয়টি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অন্য আলোচনা করেছি। প্রথমত : ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের ফরেন পলিসি অ্যাডভাইজার মিস ভেরুনিকা মুসিলভার সঙ্গে। দ্বিতীয়ত : বৈঠক হয় বেলজিয়াম সরকারি প্রতিনিধি ফ্রান্সিস দেলহের সঙ্গে। তৃতীয়ত : বৈঠক হয় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মাইগ্রেশন অ্যান্ড হোম অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর জেনারেল মাইকেল সটারের সঙ্গে। চতুর্থত : বৈঠক ছিল ইউরোপিয়ান কমিশনের সঙ্গে। পঞ্চমত : বেলজিয়াম ইকোনমিকস মিশনস ও স্টেটস ফিজিট অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টরের সঙ্গে। এর বাইরেও আমরা কিছু বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছি।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। কিন্তু আমাদের বিপুলসংখ্যক জনশক্তি রয়েছে। তাদের আমরা আহ্বান করেছি তারা যেন আমাদের দেশে ইনভেস্ট করে। বিশ্বের ১৫ শক্তিশালী ইকোনোমিক দেশের মধ্যে সাতটিই কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের। আমরা বলেছি আপনারা যদি আসেন তাহলে এখানে উভয় লাভবান হব। আসলে আপনারা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবেন কারণ আমাদের দেশের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক পাওয়া খুবই সহজ এবং এটা তুলনামূলকভাবে কম খরচে সম্ভব। এতে করে আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমাদের ম্যানপাওয়ার স্কিল ডেভেলপ হবে। শিল্পে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসবে দেশে তখন অস্থির পরিস্থিতি তৈরির সংখ্যা থাকবে না। শিল্প খাতে স্থিতিশীল থাকলে সেই দেশ কখনো এগিয়ে যেতে পারে না৷ এজন্য দেশে স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।
জামায়াত আমির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য দেশে একটি ইকোনমিক ড্রোন তৈরি করা জরুরি। তাতে করে একটা ভালো পরিবেশ তৈরি হবে। এটা আলোচনার মাধ্যমে সেটেল করা সম্ভব, এটা চলমান প্রক্রিয়া। অবশ্যই, এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যাপক উৎসাহ প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে মাত্র একজন অ্যাম্বাসেডর আছেন। এ বিষয়গুলো গতিশীল করার জন্য সবগুলো দেশের এম্বাসি আমাদের দেশে নেই, এই মিশনগুলো চালু করা। এগুলো না থাকার কারণে আমরা যেমন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের এসেছি, কিন্তু আমাদের ভিসা নিয়ে আসতে হয়েছে সুইডেনের।
সংবাদ সম্মেলনের সঞ্চালনা করেন দলটির সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, দলের নায়েবে আমির অধ্যপক মুজিবুর রহমান, আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটি এম মাসুম, রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা আব্দুল হালিম, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, অধ্যাপক ইজ্জত উল্লাহ, নুরুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন।