গত বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টা। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ একের পর এক ফাইলে সই করে চলেছেন। কাজের ফাঁকে হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘কেরানির কাজ করতে করতে সময় পার করছি।’ জাতিকে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চান বলে জানান তিনি।
সন্ধ্যায় ইসিতে থাকা আরেক কর্মকর্তা বলছিলেন, নতুন কমিশন শপথ নেওয়ার পর আজকের দিনটি ছিল ব্যস্ততম। সব ধরনের নির্বাচনি কাজ গোছাচ্ছে ইসি। সব সেক্টরে কাজ চলছে। সবই সংসদ নির্বাচন-কেন্দ্রিক।
এদিন সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনি আচরণবিধি নিয়ে এ সংক্রান্ত কমিটি বৈঠক করেছে। প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনার কাজে ব্যস্ত থাকা কমিটিও বৈঠক করে। রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও ইসিতে যান নানা বিষয়ে কথা বলতে। ইসির একটি বড় দল এখন লন্ডন, আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। আরেক দল কাজ করছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ আরও সাতটি দেশে। তারা উপায় খুঁজছেন, কীভাবে প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনা যায়।
শুধু তাই নয়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচনি আচরণবিধিমালা তৈরি, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক নীতিমালা, ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা, সীমানা নির্ধারণসহ আরও অনেক নির্বাচনি কাজ এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। এসব কাজে সিইসিসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইসির প্রত্যাশা, ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকবে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি।
নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে— এমন আলোচনার সময় ইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার বলছে, ভোট ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। ইসি ডিসেম্বরকে ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ধারণা, নির্বাচন হয়ে যাবে ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে। আর যদি জানুয়ারিতে না হয়, তাহলে ঈদুল ফিতরের পর অর্থাৎ মে মাসের মধ্যেই ভোট হয়ে যাবে। এরপর বিভিন্ন দৈব-দুর্বিপাকের কারণে ভোট করা প্রায় অসম্ভব।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পুরোপুরি নির্বাচনি ট্রেনে ইসি।
অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে বলে আসছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে ভোট হবে। ইসির সিনিয়র সচিবের ভাষ্য, সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকার বিকল্প নেই। নতুন এক প্রেক্ষাপট, সব কাজ যথাযথভাবে শেষ করতে হবে। আইন-কানুনের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। আগে আগে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে পারলে সামনে চিন্তামুক্ত থাকা যাবে। সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমরা নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভোট করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।’
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নামে একটি কমিশন গঠন করে। ওই কমিশন সরকারের ঐকমত্য কমিশনের কাছে একটি সুপারিশ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এসব সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছে। রাজনৈতিক দলগুলো কোনো পরামর্শের সঙ্গে একমত হচ্ছে, কোনোটার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে। অন্যদিকে এসব কথায় কান না দিয়ে সংসদ নির্বাচনের জন্য জরুরি মনে করা কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। তার জন্য যা যা করা দরকার, তা করা হচ্ছে।
নির্বাচনের পথে ইসি শুধু হাঁটছেই না, দৌঁড়াচ্ছেও বটে। নতুন দলের নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তিসহ বেশিকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ নিয়েছে ইসি। ইসির দাবি, ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে হলে আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হবে।
ইসির এসব পদক্ষেপ নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে ইসির এসব উদ্যোগ কাম্য নয়। ভবিষ্যতে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। সরকারের মত নিয়ে ইসির এগোনো উচিত।’
যদিও সংস্কার প্রস্তাব সংক্রান্ত প্রতিবেদনের বেশ কিছু ধারার সঙ্গে ইসি ভিন্নমত পোষণ করে চিঠি দিয়েছে সরকারের ঐকমত্য কমিশনের কাছে।
ইসি সচিবের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে বদিউল আলম মজুমদারের ওই মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তখন আখতার আহমেদ বলেন, ‘তাহলে ইসির সাংবিধানিক স্বাধীনতা থাকল না।’
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইসি সচিব বলেন, আমাদের প্রস্তুতি ডিসেম্বর জানুয়ারি নিয়ে না। ইলেকশনের তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে তো এ বিষয়ে একটা কানেকশন থাকে। আমাদের বলা হয়েছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা। এখন আমাদের প্রস্তুতি তো থাকতে হবে। প্রস্তুতি না থাকলে আমরা কীভাবে এগোব?
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এখনও পাস হয়নি, তার আগেই সব কাজ গোছাচ্ছে ইসি— প্রতিবেদকের এ কথার জবাবে ইসি সচিব বলেন, আমরা কাজ না করে ঘুমাব নাকি? এই যেমন ধরেন, ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা, এটা নির্ধারণের এখতিয়ার কমিশনের। ফলে, ইলেকশন কমিশনকে কাজ করতে হবে। যেগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সেগুলো সেখান থেকে আসুক।
ডিসেম্বরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে ইসি সীমানা পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ নিলেও আইন সংশোধনের জটিলতায় আটকে আছে এই প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই দেশের ৫৫টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে কমিশনের কাছে ৩৮৯টি আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদনের বেশিরভাগই ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। সংশোধিত আইন হাতে পেলে তিন মাসের মধ্যে ভৌগলিক অবস্থান, আয়তন ও জনশুমারিকে গুরুত্ব দিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করতে চায় সাংবিধানিক এ সংস্থাটি।
আইন সংশোধনের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইসি সচিব আখতার বলেন, ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণের আইন পাসের ব্যাপারটা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। যদি আইন পাস না হয়, তাহলে আগের সীমানা নির্ধারণ আইন বহাল থাকবে। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলতে থাকবে।’
নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে সরকারের যোযোযোগ হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘কমিশনের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে এবং হচ্ছে না, দুটোই সঠিক। আমরা একটি ফাইল পাঠিয়েছি, এটাও সরকারের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ।’
এই যখন পরিস্থিতি, তখন নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে, কোনো সহযোগিতা লাগবে কিনা, এসব বিষয়ে জানতে নিয়মিত ইসিতে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনাররা।
সম্প্রতি ইসিতে যান অষ্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার সুসান রাইলি। ইসিকে জানান, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। সে সময় সিইসি নির্বাচনের সামগ্রিক প্রস্তুতির কথা জানান রাইলিকে। বৈঠক থেকে বের হয়ে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ভোটার লিস্টটা আমরা অলমোস্ট শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। আমরা প্রকিউরমেন্ট শুরু করেছি। ডিলিমিটেশনের জন্য আমরা ইনিশিয়েটিভ নিয়েছি, এখানে একটি আইনের সংশোধন দরকার। সেটা হয়ে গেলে, ওটাও আমরা করে ফেলব।
সিইসি বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে উনারাই বলে দেবেন, কখন কীভাবে কী করবেন। এটা আমাদের হাতে নেই। যেগেুলো রাজনৈতিক আছে, যেগুলোতে রাজনীতি ইনভলব আছে, এটা উনারা করে আমাদের সিদ্ধান্ত দেবেন। তখন আমরা জানব। উনারা কী দেবেন, কী ধরনের দেবেন, আমরা তো আর জানি না। যেগুলো আমাদের ক্ষমতার মধ্যে আছে, ইলেকশনের আগে যেগুলো আমরা প্রয়োজনীয় মনে করছি বা করা সম্ভব মনে করছি, উই আর ওয়ার্কিং অন দ্যাট।’