দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বাড়ছে। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে অনড় অবস্থানে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। রাজপথেই চূড়ান্ত ফয়সালা করার কথা বলছে তারা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে ছাড় দিতে রাজি নয়। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি কোনো দিকে যাবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত কমিশন।
নির্বাচন কমিশন ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রোডম্যাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান।
জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে আনিছুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আশঙ্কা বা থ্রেট নাই। আর নির্বাচনকালীন সরকার এবং সব দলের নির্বাচনে আসা রাজনৈতিক দল ও সরকারের বিষয়। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেব।’
৩০০ আসনেই ব্যালটে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি জানিয়েছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। তারা তাদের রোডম্যাপ ধরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যখন যে কাজ করা প্রয়োজন, তখন সেই কাজ শেষ করেছে। বলতে গেলে পূর্ব প্রস্তুতি প্রায় শেষ।
নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ, ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনী সামগ্রী কেনা, নির্বাচনের প্রতীক ঠিক করা এসব পূর্ব প্রস্তুতির মধ্যে পড়ে। এছাড়া আছে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি প্রভৃত।
নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজনৈতিক দল ও স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। বিএনপি ও তাদের সমমনারা সেই সংলাপে যায়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল। তবে তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বরের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের যে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছিল তাতে নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল এবং ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছর জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল।
নির্বাচন কশিনার মো. আনিছুর রহমান সুনির্দিষ্টভাবেই জানিয়েছেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানিয়েছেন, ‘ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকা পুনর্বিন্যাস, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা- এগুলো হয়ে গেছে। নির্বাচনী মালামাল কেনা প্রক্রিয়াধীন আছে। ভোট কেন্দ্র এবং পোলিং পার্সোনাল নিয়োগ করা হবে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের পর, সেটা গোছানো আছে। নির্বাচনের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ (টিওটি) সেটা চলছে।’
জাহাংগীর আলম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি ঠিকমতো এগিয়ে নিচ্ছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ অবশ্যই ভালো আছে। কোনো দলের নির্বাচনে আসা বা না আসা সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের কমিশনের দেখার কাজ নয়।’
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা যথাসময়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। নভেম্বরের মধ্যেই আমাদের নির্বাচনী সামগ্রী সব পেয়ে যাব। ভোটার তালিকা, সীমানা নির্ধারণ ছাড়াও নতুন দলের নিবন্ধন আমরা দিয়েছি। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক একাংশকে অনুমোদন দিয়েছি। বাকিদের বিষয় প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এবার প্রশিক্ষণ আমরা দুই দিনের করছি। ডিসি এবং এসপিদের সঙ্গে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বৈঠক হবে। মোট কথা, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে বলতে গেলে এগিয়ে আছি।’
এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে যত চ্যালেঞ্জ তাও আমরা মাথায় রাখছি। আমাদের টার্গেট একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেরায় ইলেকশন। তার জন্য যা করার সবই আমরা করছি। তবে নির্বাচনকালীন সরকার একটি রাজনৈতিক বিষয়, এটা সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সমাধান করবে। আর পার্টিসিপেটরি নির্বাচনের ব্যাপারে কথা হলো, আমরা একটা লেভেলপ্লেইং ফিল্ড তৈরি করে দেব। আমরা চাই সবাই যেন নির্বাচনে অংশ নেন। এখন কেউ নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটা রাজনৈতিক ব্যাপার। সেটা তো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।’
তার মতে, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কোনো আশঙ্কা বা থ্রেট নাই, যা হচ্ছে সেটা তো রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ।’
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের যে প্রস্তুতির কথা কমিশন বলছে, সেটা ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বিদেশে এবং দেশে সবখানেই বিতর্ক আছে। আন্তর্জাতিকভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। ফলে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে, এটা বলার সুযোগ নেই নির্বাচন কমিশনের। এটা নিয়ে তাদের খুব বেশি কিছু করার নেই। তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে। সেই অনুযায়ী, সময়ের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে তাদেরও আস্থা অর্জনের বিষয় আছে।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংবিধানে কিছু না থাকলেও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিতর্ক আছে। বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর সরকার তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে চায়। এটা নিয়ে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি, এটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা দরকার।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের মতে ‘সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে নানা সংকট তৈরি হবে। দেশের অর্থনীতিও ব্যাপক চাপের মুখে পড়বে।’