পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে দুই শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন শতাধিক। আহত হয়েছেন প্রায় ৪০০। নিহতের মধ্যে দুইজন চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং ছয়জন সদস্য প্রার্থী রয়েছেন। এসব ঘটনায় দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে।এসব মামলায় দেড়শ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আসামি আছেন আরও কয়েকশ। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ৫০ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
র্যাব ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে প্রার্থী এবং পরে ফলাফল মেনে না নেওয়ার প্রবণতা থেকেই ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। ফলাফল অনুকূলে না আসায় পরাজিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সমর্থকরা আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করছেন।উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছেন। লিপ্ত হচ্ছেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। ভোট গণনা এবং ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বেশি। তবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই নির্বাচন ঘিরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সংঘর্ষ, পালটাপালটি ধাওয়া শুরু হয়।
এ অবস্থায় সামনের নির্বাচনে শুধু ভোটের দিন নয়, প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে ভোটের ২/১ দিন পর পর্যন্ত সংহিংসতা রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এজন্য র্যাব-বিজিবির টহল আরও জোরদার করতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ধাপে ৩৭৫৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে ১৬৮৮ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র বা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হয়েছেন ৮০৮ জন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন আওয়ামী লীগের ৩৪৬ জন প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্দলীয় ৪০৮, বিএনপি সমর্থক ৩৪১, জামায়াত সমর্থক ৪০ জন এবং জাতীয় পার্টি সমর্থক ৫১ জন বিজয়ী হয়েছেন। ৩৯টি ইউনিয়নের ফলাফল স্থগিত রয়েছে। এই ৩৯টির মধ্যে চতুর্থ ধাপে স্থগিতের সংখ্যা বেশি (২০টি)। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে নয়টি ইউনিয়নের ফল স্থগিত রাখা হয়।
এছাড়া তৃতীয় ধাপের তিনটি, দ্বিতীয় ধাপের চারটি এবং প্রথম ধাপের দ্বিতীয় খণ্ডের নির্বাচনে তিন ইউনিয়নের ফলাফল স্থগিত আছে। প্রথম ধাপের প্রথম খণ্ডের নির্বাচনে কোনো কোনো ইউনিয়নের ফল স্থগিত নেই। ইউপি নির্বাচনে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জানতে চাইলে বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি হায়দার আলী খান যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনগুলোয় যেভাবে সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাভেই কাম্য নয়।
সামনে নির্বাচনকে ঘিরে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারণ, আমরা চাই না জানমালের ক্ষতি হোক। প্রতিটি প্রাণের অনেক দাম। তিনি বলেন, পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে প্রার্থীর সমর্থকরা বেশি বেপরোয়া ছিলেন। তারা পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে হামলা করেছেন। পুলিশের কাজ হলো মানুষকে নিরাপদে রাখা। যখন পুলিশই আক্রান্ত হয়, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি হায়দার আলী খান বলেন, সব সময়ের মতো আমরা জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন কোনো সংঘাতে না জড়ান। এতে প্রার্থীরই বেশি ক্ষতি হয়। উভয় পক্ষই সমস্যায় পড়ে। নির্বাচনে হার-জিত থাকবেই। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতেই পুলিশ কাজ করে। তিনি বলেন, জনগণের রায়কে যারা গুরুত্ব দেবে না, তাদের বিষয়ে পুলিশের অবস্থান কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক বেশি। সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন করা সম্ভব হয় না। ঝুঁকি বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোয় বেশি ফোর্স মোতায়েন করা হয়। তারপরও ঘটনা ঘটছে।
অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনা করে সামনের নির্বাচনের নিরাপত্তা ছক আঁকা হচ্ছে বলে ডিআইজি জানান। তিনি জানান, প্রতিটি ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ স্পটে গিয়েছে। না হলে আরও বেশি সংঘর্ষ হতো। বাড়ত প্রাণহানির সংখ্যাও। সূত্রমতে, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বেশি সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে নরসিংদী ও মুন্সিগঞ্জ জেলায়। তৃতীয় ধাপে বেশি সহিংসতা হয়েছে ঠাকুরগাঁও, যশোর, মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীতে।
তৃতীয় ধাপে ভোট গণনার সময় ঠাকুরগাঁওয়ে তিনজন, মুন্সিগঞ্জে দুইজন, নরসিংদীতে দুইজন এবং কিশোরগঞ্জ ও কক্সবাজারে একজন করে নিহত হয়েছেন। এছাড়া তৃতীয় ধাপের নির্বাচন চলাকালে লক্ষ্মীপুরে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ভোট গণনা শেষে নীলফামারীতে সহিংসতায় একজন বিজিবি সদস্য নিহত হন।
যশোর, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল (দুইজন), নওগাঁ ও খুলনায় তৃতীয় ধাপের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাতজন নিহত হয়েছেন। চতুর্থ ধাপে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় দুইজন করে এবং নির্বাচনের দিন পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী, সিলেট ও ফরিদপুরে একজন করে নয়জন নিহত হয়েছেন।
৭০৭টি ইউনিয়নে পঞ্চম ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ ডিসেম্বর। এই ধাপে ঝিনাইদহে দুইজন এবং কুমিল্লা এবং নওগাঁয় একজন করে নিহত হয়েছেন। নির্বাচনের দিন বগুড়ায় পাঁচজন এবং মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর ও নওগাঁয় একজন করে নিহত হয়েছেন। ২১৯টি ইউনিয়নে ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩১ জানুয়ারি। এই নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুইজন নিহত হয়েছেন। ১৩৮টি ইউনিয়নে সপ্তম ধাপের নির্বাচন হবে ৭ ফেব্রুয়ারি।
গত পাঁচ ধাপের নির্বাচনের সহিংসতা-সংঘর্ষ এবং সামনের নির্বাচনের নিরাপত্তা প্রস্তুতির বিষয়ে কথা হয় র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নির্বাচনে র্যাব মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে কাজ করে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে। নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডবিরোধী অভিযান চালানো হয়।
তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে যেসব সহিংসতা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো খুবই আনাকাক্সিক্ষত। ঘটনার পরবর্তী সময়ে র্যাব বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেফতার করেছে। তিনি বলেন, সামনের নির্বাচনে সহিংসতা এড়াতে এবং হতাহত রোধ করতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিহার করতে হবে।
র্যাব পরিচালক বলেন, কেন্দ্রগুলোয় নিরাপত্তাব্যবস্থা জেরাদারের কোনো বিকল্প নেই। ভোট গণনা শেষে ফল প্রকাশে অহেতুক বিলম্ব করা যাবে না। রাত্রিকালীন ভোট গণনার সময় নির্বাচনি কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। ফলাফল ঘোষণা শেষে নির্বাচনি সামগ্রী উপজেলা নির্বাচন অফিসে পৌঁছানোর জন্য বিশেষ নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত যানবাহনের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনি কেন্দ্রগুলোয় সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সংখ্যা কম থাকে। তাই কেন্দ্রগুলোয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন হয়েছে দুইটি খণ্ডে। গত বছরের ২১ জুন প্রথম খণ্ড এবং ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় খণ্ডে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। দুই খণ্ডের নির্বাচনে ভোটের দিন নিহত হয়েছেন ছয়জন। ২১ জুন চারজন এবং ২০ সেপ্টেম্বর দুইজন নিহত হন। এ দুই খণ্ডের নির্বাচনে আহত হয়েছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে নির্বাচনের দিনই ২৫ জন আহত হন। অন্য ২০ জন অহত হন ভোট-পূর্ববর্তী সময়ের সহিসংতায়। দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১১ নভেম্বর। এই ধাপে নিহত হন ৩১ জন।
এর মধ্যে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ১৮ জন, ভোটের দিন আটজন এবং ভোট-পরবর্তী সহিংসতায় পাঁচজন নিহত হন। এই ধাপের নির্বাচনে আহত হন ৭০ জন। এর মধ্যে প্রচারের সময় ৫৫ জন এবং নির্বাচনের দিন ১৫ জন আহত হন। তৃতীয় ধাপের ভোট হয় ২৮ নভেম্বর। এতে ১৮ জন নিহত এবং ৭৫ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে নির্বাচনের দিন ১১, পূর্ববর্তী সময়ে ছয় এবং পরবর্তী সহিংসতায় একজন মারা যান।
এছাড়া নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতায় ৫৫ জন এবং নির্বাচনের দিন সহিংসতায় ৪০ জন আহত হন। চতুর্থ ধাপের ভোট হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে নয়জন নিহত এবং ৯৩ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে নির্বাচনের দিন পাঁচজন, নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে দুইজন করে নিহত হন। এছাড়া নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতায় ৭০ জন এবং ভোটের দিন নির্বাচনি সহিংসতায় ২৩ জন আহত হন।