বর্তমানে অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জগুলো বাংলাদেশের সামনে আছে, সেগুলো বেশ কিছুদিন ধরে সবার কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই অর্থনীতি নিয়ে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, সেগুলো প্রকট হয়ে উঠছে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে মোকাবেলা করছে। বাংলাদেশেও আমাদের নিজেদের তাগিদে সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।
প্রথমে এটা বলে রাখা দরকার, মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। রপ্তানি বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রেমিট্যান্সের সমস্যা আছে। বিশেষ করে এই চ্যালেঞ্জগুলো এখন একটু বেশি প্রমিনেন্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এগুলোর মূল কারণ হিসেবে আমরা সাধারণত বলে থাকি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কিংবা কভিড-১৯। সেগুলো তো আছেই। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ ও বেশ কিছু সমস্যা অনেক আগে থেকেই ছিল। সেগুলো সময়মতো প্রত্যক্ষভাবে মোকাবেলা করার ব্যাপারে আমরা তেমন কার্যকর ভূমিকা দেখতে পাইনি।
এখনো পর্যন্ত আমরা যেটা অনুভব করছি সেটা হলো, সমন্বিত এবং পরিপূর্ণ কতগুলো পদক্ষেপ নিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে দেখছি না। তবে সম্প্রতি আইএমএফ মিশন আসার পর তারা নানা সমস্যার কথা বলেছে। তারা কিছু শর্ত দিয়েছে। অনেক সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গবেষক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকাররা কিন্তু বারবার এসব সমস্যার কথাই বলছেন। সরকার এগুলো জানে, স্বীকারও করে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আইএমএফ মোটা দাগে যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছে; ব্যাংকিং সেক্টরে রিফর্ম, ডিফল্ট লোন, করাপশন, মুদ্রাপাচার, সুদের হার, এক্সচেঞ্জ হার ইত্যাদি। তারা বলছে, একদম যুক্তিসংগতভাবে এগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে।
আমার প্রথম অবজারভেশনটা হলো, এই সমস্যাগুলো খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এগুলো তো জানা সমস্যা, এগুলোর কারণ কী? কারণগুলো বের করতে পারলেই তখন সমস্যাগুলোর একটা সমাধানও পাওয়া যাবে। একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ রয়েছে। যেমন—ফরেন এক্সচেঞ্জের সঙ্গে রেমিট্যান্স সম্পর্কিত। এটার সঙ্গে সম্পর্কিত রপ্তানি বাণিজ্য কমে গেছে, আমদানি বেড়ে গেছে। আমদানি কী কারণে বেড়েছে, কী কী বেড়েছে, সেগুলো বের করতে হবে। তারপর এফডিআই, বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।
অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়, এখানে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর, বিডার (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) ভূমিকা আছে, এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও ভূমিকা আছে। তারপর মানি লন্ডারিং রোধ করার বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা আছে। সবাই মিলে যদি সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সমস্যা সমাধান কঠিন হবে। আপনি একটা ঠিক করতে যাবেন, সেটা অন্যদিকে সমস্যা দেখা যাবে। অতএব এই ব্যাপারটি অনুধাবন করা উচিত। এটা নয় যে সব একসঙ্গে করে ফেলবেন, সব সমস্যা সমাধান করে ফেলবেন, সব কিছু সংস্কার করে ফেলবেন। কতগুলো বেসিক জিনিস, সেগুলোর একসঙ্গে একযোগে সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের সমস্যার অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জগুলো বেশি। অভ্যন্তরীণটা যদি আমরা সমাধান করতে পারি, আমাদের নিজস্ব শক্তি যদি আমরা নিজেরা অর্জন করতে পারি, তাহলে বাইরে থেকে দাতা সংস্থা কী বলবে, কী শর্ত দেবে, সেটা ইমম্যাটেরিয়াল, এটা খুব বিরাট ব্যাপার না; আইএমএফ হয়তো আরো শর্ত দেবে—কৃষি থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে বলবে, আরো অনেক কিছু আছে, সেগুলো তো বাংলাদেশ সরকার নেগোশিয়েট করবে। কৃষি খাত, গ্যাস, জ্বালানি, খাদ্য আমদানি এগুলোর ওপর সরকারের প্রণোদনা বন্ধ করলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আইএমএফ এসব উঠিয়ে দিতে বলবে। সেসব যে মানতে হবে ও রকম কথা নেই।
কিছু কাজ আমাদের নিজস্ব তাগিদে আগে করা প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের নীতি যেগুলো নেওয়া হয়েছে; এই নীতি এবং কৌশলগুলো, আমি মনে করি, তাতে অনেক ভুল ছিল। আট-দশ বছর ধরে শুধু আমরা প্রবৃদ্ধি ভালো হয়েছে বলি, সেটা ভালো কথা। আমরা শুধু প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান, আয়ের বৈষম্য ও সম্পদের বৈষম্য—এগুলোর প্রতিফলন রয়েছে সমাজে। এখন তো মানুষের অসুবিধা হচ্ছে, আয় কমে গেছে, অনেকেরই তো নির্ধারিত আয়। আমাদের মনিটরি পলিসি, রাজস্ব পলিসিতে ভ্রান্ত কিছু নিয়ম আছে, বাণিজ্যনীতিতে কিছু সমস্যা আছে—এগুলো নতুন করে দেখতে হবে।
এখন প্রথম দরকার পুরনো কৌশল, পুরনো নীতি—এগুলো পর্যালোচনা করে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে। একই সরলরেখায় সামনের দিকে আমরা যাব, সেটা আর হবে না। এটা সরলরেখা না হয়ে নিচের দিকে নেমে আসতে পারে। এখন ওপরের দিকে উঠতে হবে। ওপরে উঠলে আবার হয়তো নিচের দিকে নামার চ্যালেঞ্জ থাকবে। অতএব যেটাকে আমরা নন-লিনিয়ার বলি সে রকম পথে যেতে হতে পারে।
দ্বিতীয়ত হলো, খুব দ্রুত আমাদের যেটা দরকার সেটা হলো আমাদের কতগুলো পলিসি আছে, যেটা আমরা অনেক দিন ধরে বলছি। আমাদের রাজস্বনীতি, সরকারের ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার আছে, সরকার রেভিনিউ কিভাবে বাড়াবে সেটা নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন। ট্যাক্স বাড়ানো দরকার। সরকারের অর্থ কোথায় ব্যয় করবে, বড় বড় মেগাপ্রজেক্ট বা অন্যান্য প্রজেক্ট; যেগুলোর কোনো প্রায়োরিটি নেই। আবার কিছু অর্থের অপচয় হচ্ছে। পাঁচ বছরের প্রজেক্ট ১৫ বছরে শেষ হচ্ছে। এখন ওই দিকে যথেষ্ট নজর দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা হলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেটা মনিটরিং পলিসি, সেন্ট্রাল ব্যাংকের পলিসি, এক্সপোর্ট পলিসি; এগুলো কমপ্লিমেন্ট করবে। এগুলো একযোগে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
অতএব এই পর্যায়ে দুটি জায়গায় ঠিক করতে হবে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ও রাজস্বনীতি। ভর্তুকি বলি বা প্রণোদনা বলি, সেটা কোথায় কোথায় দেওয়া হচ্ছে? বড় বড় শিল্পে? এক্সপোর্টে? কিন্তু ছোট ছোট শিল্পে প্রণোদনা দেওয়ার কী হলো? ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের কিভাবে ঋণ দেওয়া হবে? তাদের কিভাবে ঋণ বেশি দেওয়া যাবে—এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা খুব বেশি হয় না। বাজেটে এগুলোর কোনো প্রতিফলন থাকে না। এখন এগুলো চিন্তা করার সময় এসেছে।
এ জন্য তিনটি জিনিস সবচেয়ে বেশি দরকার। একটা হলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে, এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ক্ষেত্রে কিছুটা সংস্কার আনতে হবে। ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছুদিন কোনো রিফর্ম হয়নি। অনেক পরিচালক; ফ্যামিলি পরিচালকদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমি রিফর্ম বলতে একবারে আইন বদল করে ফেলবেন, সেটা বলছি না, কিছু কিছু সংস্কার ইমিডিয়েটলি করা যায়।
দ্বিতীয়ত, আমাদের পুরো ইকোনমির যে এখানে বিভিন্ন মার্কেট, ইনস্টিটিউশন, ব্যাংক, তারপর রেগুলেটরি বডিজ, এখানে ব্যুরোক্রেসির রোল আছে। সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা আছে, লোকাল লেভেলে প্রশাসন আছে, লোকাল লেভেলে ব্যবস্থাপনা আছে। সবাই যদি একযোগে এগুলোর স্ট্রাকচারটাকে সুসংহত না করি, তাহলে হবে না। এ জন্য স্ট্রাকচারকে সুসংহত করতে হবে। এবং একযোগে সবাইকে সচেতন করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং আমলাতন্ত্র—এখানে দক্ষতার অভাব আছে। একটা উদাহরণ দিই, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা কম্পিটিশনে অন্যদের সঙ্গে পারছি না কেন? গার্মেন্টের নিজস্ব প্রডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতায় আমরা পারি না। কারণ আমাদের প্রডাক্টিভিটি লো। যোগাযোগব্যবস্থা ও পোর্টের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি। আপনি দেখবেন যে সরকারের যে তথ্যগুলো দেয় সেগুলো দেরিতে আসছে। মূল্যস্ফীতির তথ্য। জিডিপির তথ্য দেরিতে আসে। এখন তো বিদেশি সংস্থারাও বলে, তোমাদের তথ্যের ঠিক নেই। এটা তো একটা উদাহরণ। যেখানে আইএমএফ বলছে, তোমাদের রিজার্ভের তথ্য ঠিক হয়নি। অতএব তথ্যগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করা এবং বাইরের লোকদের জানানোর ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য তুলে ধরা জরুরি। অনেক কিছু বাইরের লোকজন জানেও না। সরকারের বহু পদক্ষেপ দৃশ্যমান ও স্বচ্ছ হয় না, সরকার কী করবে, কোন ক্ষেত্রে কী করবে সেটা সাধারণ মানুষ জানে না। এই যে মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারে বলেছে, আমরা তথ্য নেব। কার কাছ থেকে নেবে, কার সম্পর্কে নেবে? দুই-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া হোক যে অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে।
এগুলো না হলে ব্যাংক, পুঁজিবাজার, সরকারি সংস্থার ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে যাবে। তেমনটি হলে জনগণের অংশগ্রহণ ও জনগণের সহযোগিতা পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। জনগণকে শুধু বলবেন, কৃচ্ছ্র সাধন করো, তোমরা কষ্ট করো—এটা ফলপ্রসূ হবে না। জনগণ তো এমনিতেই কষ্ট করে। হ্যাঁ, তারা কষ্ট করবে, যখন তারা জানবে এ রকম অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটার ফল ভালো হবে—তখন জনগণ নিজে থেকে কষ্ট করবে। তারা এখন যথেষ্ট সজাগ। তবে জনগণের কল্যাণ ও তাদের ইচ্ছাটার দিকেও নজর দিতে হবে। জনগণের সহায়তায় তবেই কিন্তু আমরা বর্তমান সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব। সংকটগুলোর দ্রুত সমাধান করতে পারব।