পর্তুগিজ ক্লাব বেনফিকা থেকে সাড়ে সাত কোটি ইউরোর বিনিময়ে লিভারপুলে যোগ দিতে যাচ্ছেন ডারউইন নুনেজ। ইংলিশ ক্লাবটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন এই উরুগুয়েন ফুটবলার। কিন্তু নুনেজ শৈশবে জীবন ধারণের জন্য নিয়মিত পেতেন না খাবার। খালি পেটে পার করেছেন অনেক রাত।
যা কখনোই ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ভুলতে পারেননি নুনেজও।
জন্ম উরুগুয়ের আরতিগাস শহরে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। বাবা-মা ও ছোট্ট এক ভাইকে নিয়ে ছিল পরিবার। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তার বাবা। আয় ছিল সামান্য। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো বাবা বিবিয়ানো নুনেজকে। একসময় নুনেজের বাবার আয় বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেন তার মা সিলভিয়া রোমেইরো। রাস্তার পড়ে থাকা বোতল কুড়িয়ে যা আয় করতেন তা দিয়ে দুই ছেলের খাবার নিশ্চিত করতে পারতেন, সেটাও আবার নিয়মিত ছিল না। নুনেজের শৈশবের সবচেয়ে দুঃখজনক অভিজ্ঞতা ছিল, না খেয়ে খালি পেটে রাত পার করতে হয়েছে তাকে। শুধু তিনিই নন, তার মা-বাবাও অনাহারে পার করেছেন কত রাত; তার হিসাব নেই।
নুনেজ এখন লিভারপুলের জার্সি গায়ে মাতাবেন। এখন হয়তো নেই আর কোনো অভাব। না খেয়ে থাকতে হয় না তার ভাই ও মা-বাবাকে। কিন্তু শৈশবের সেই সময়টা কি কখনো ভুলতে পারবেন তিনি? এর আগে গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার নুনেজ বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি খালি পেট নিয়েই বিছানায় ঘুমাতে যেতাম। তবে যিনি খালি পেটে সবচেয়ে বেশি বিছানায় যেতেন তিনি ছিলেন আমার মা। ছোট ভাই আর আমি খেয়েছি কিনা নিশ্চিত হওয়াই ছিল আমার মায়ের কাজ। না খেয়েই আমার মা বিছানায় যেতেন। আমি কোথা থেকে এসেছি তা আমি কখনোই ভুলব না। ‘
অন্য একটি সাক্ষাৎকারে নুনেজ বলেছিলেন, ‘আমার খেলার বুট এনে দিতে মা ও বাবা অনেক পরিশ্রম করেছে। আমার পরিবার ছিল ভদ্র ও কঠোর পরিশ্রমী। আমার বাবা আট-নয় ঘণ্টা কাজ করত, যাতে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারে। আমার মা ছিল গৃহিণী; কিন্তু আমাদের জন্য সে রাস্তায় বোতল খুঁজতে যেত, যা বিক্রি করে আমাদের কিছুটা হলেও চাহিদা মেটাত। ‘
২০১৩ সালে উরুগুয়েন ক্লাব পেনারোলে ট্রায়াল দিতে আরতিগাস থেকে মন্টেভিডিওতে যান নুনেজ। কিন্তু ১৪ বছর বয়সী নুনেজ পেনারোলে সুযোগ না পেয়ে ফিরে আসেন মা-বাবার কাছে। পরের বছর আবারও পেনারোলে যান। এবার টিকে যান ক্লাবটিতে। কিন্তু ভাগ্যদেবী সহায় হননি এবারও। সেখানে কয়েক মাস কাটানোর পর লিগামেন্টের ইনজুরিতে পড়েন। দেড় বছরের মতো মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাকে। করাতে হয় অস্ত্রোপচার।
ইনজুরি কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা নুনেজের আবারও পেনারোল থেকে ডাক আসে। দলটির কোচ লিও রামোস তাকে মূল দলে খেলতে প্রস্তাব দেন। পেনারোলে এবারের ফেরাটা আর দুঃখময় ছিল না নুনেজের জন্য। ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় তার। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই পায়ে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। আবারও পায়ে করতে হয় অস্ত্রোপচার। এবারও এক বছর মাঠের বাইরে থাকেন তিনি। তবে হার মানেননি নুনেজ। দুর্দান্তভাবে ফিরে এসে জায়গা করে নেন ২০১৯ লাতিন আমেরিকা অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে উরুগুয়ের বয়সভিত্তিক স্কোয়াডে। ফেরাটা যতটা আকর্ষণীয় ছিল মাঠের পারফরম্যান্সে ততটাই ছিলেন মলিন। যা হতাশ করেছিল সবাইকে।
সে বছরেই পেনারোল ছেড়ে স্প্যানিশ ক্লাব আলমেরিয়ায় চলে আসেন নুনেজ। এক মৌসুমে ক্লাবটির জার্সিতে ১৬টি গোল করে নজরে পড়ে যান বেনফিকার। ২০২০ সালে পর্তুগিজ ক্লাবটিতে যোগ দেওয়ার পরের গল্প তো সবারই জানা। প্রথম বছরে ১৪ এবং গত মৌসুমে বেনফিকার জার্সিতে করেছেন ৩৪ গোল। চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনালে এই লিভারপুলের বিপক্ষে উভয় লেগেই পেয়েছিলেন জালের দেখা। সেই লিভারপুলের জার্সিতেই আগামী মৌসুমে মাঠ মাতাবেন ২২ বছর বয়সী নুনেজ।
ধৈর্য ও পরিশ্রম; মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। নুনেজের ক্ষেত্রেও হয়েছে সেটিই। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রম আজ তাকে ইউরোপিয়ান ফুটবলের শিরোনাম বানিয়েছে। একসময় অভুক্ত থাকা নুনেজকে মাঠের পারফরম্যান্স বানিয়েছে লিভারপুলের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়। নিশ্চয়ই এ খবরে আনন্দে ভাসছে নুনেজের সেই ‘পরিশ্রমী পরিবার’। নুনেজও হয়তো ভাবছেন, ‘শৈশবে কী দুর্বিষহ সময় পার করেছিলাম। ‘