দুবলার চরে শুঁটকির উৎপাদন বেড়েছে। এই মৌসুমে জেলেরা ৬৫ হাজার কুইন্টাল বা ৬ হাজার ৫০০ টন শুঁটকি উৎপাদন করেছে। বন বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছরে শুঁটকির এই উৎপাদন এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এর আগে কোনো মৌসুমেই সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়নি।
শুঁটকির উৎপাদন বাড়ায় বেড়েছে বন বিভাগের রাজস্ব আদায়ও। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৪ কোটি ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৯৫৪ টাকা রাজস্ব পেয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। বন বিভাগ বলছে, মাছের উৎপাদন বাড়াতে প্রজনন মৌসুমে সাগরে মাছ আহরণে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার তার সুফল দেখা যাচ্ছে। এবার সাগরে জেলেরা মাছ বেশি পেয়েছেন। ফলে শুঁটকির উৎপাদন ও রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
সুন্দরবনের পাশে বঙ্গোপসাগরের কোণে দুবলার চর। সমুদ্রের বিশাল মৎস্য ভাণ্ডারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এখানে গড়ে ওঠে অস্থায়ী এক শুঁটকিপল্লি। সাগর তীরে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মোহনায় জেগে ওঠা বেশ কয়েকটি চর মিলে গঠিত দুবলার চর। এটি মাছের জন্য বিখ্যাত।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ থেকে জানা যায়, এবারের মৌসুমে বনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের আলোরকোল, মাঝের কেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া ও শ্যালার চরে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য অনুমতি নেয় ১ হাজারটি ঘর, ৬৬টি ডিপো ঘর ও ১৫ জন বহাদ্দার। প্রতি বছরের মতো এবারও চরগুলোতে পলিথিন, কাঠ ও খড় দিয়ে অস্থায়ী তাঁবু করে পাঁচ মাসের জন্য অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন জেলেরা। ২০২১ সালের পহেলা নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাগর থেকে ধরে আনা মাছ শুকিয়ে এসব চরে শুঁটকি উৎপাদন করেন বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনাসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার অন্তত ১০-১২ হাজার জেলে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দুবলার চরে ৪৫ হাজার ৯৭৮ দশমিক ৯৮ কুইন্টাল শুঁটকি উৎপাদনের বিপরীতে বন বিভাগ রাজস্ব পায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৪৪ হাজার ৭১৩ দশমিক ১৪ কুইন্টাল এবং রাজস্ব আয় হয় ২ কোটি ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার ২৬২ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৪১ হাজার ৫৪ দশমিক ৮৮ কুইন্টাল আর রাজস্ব আদায় হয় ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৪২ টাকা।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, চলতি অর্থবছরে এ যাবতকালের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে সর্বোচ্চ শুঁটকির উৎপাদন হয়েছে। আগে কোনো বার দুবলায় এত শুঁটকি উৎপাদন হয়নি।
শুঁটকি মৌসুমের শুরুর দিকে এবং মাঝামাঝিতে দুই দফা ঝড়-বৃষ্টি না হলে উৎপাদন আরও বাড়ত দাবি করে ডিএফও বলেন, দুবলার চারটি চরে শুঁটকি তৈরির জন্য জেলেদের পাঁচ মাসের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। এই সময় তারা বঙ্গোপসাগর থেকে ধরে আনা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করেন।
৩১ মার্চ পর্যন্ত ছিল এবারের শুঁটকি আহরণ ও উৎপাদন মৌসুম। অধিকাংশ জেলেরা এর আগে দুবলা ছেড়ে ফিরে এসেছেন। তবে এখনও কিছু জেলে ও ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনের ওই চরে রয়েছেন। তারাও ২-১ দিনে নিজেদের মালামাল গুছিয়ে বাড়ি ফিরবেন। বড় ধরনের কোনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগামী বছর শুঁটকির উৎপাদন আরও বাড়বে।
দুবলায় শুঁটকি মৌসুম শেষ করে বাড়ি ফেরা বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী গ্রামের ওমর ফারুক ও সোহেল মল্লিক বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে শুঁটকি মৌসুমে সাগরে যাই। এই সময় অস্থায়ীভাবে দুবলার চরের আলোর কোলে থাকতে হয়। দুবলায় যেতে অনেক খরচ হয়। চড়া সুদে টাকা দাদন নিতে হয়। কিন্তু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও করোনার কারণে গত দুই বছর খরচ উঠেনি। তবে এবার একটু ভালো মাছ পাওয়ায় এবং দুর্যোগ কম থাকায় ভালো শুঁটকি হইছে।
কোনো প্রকার কেমিকেল ছাড়া কেবল শুধু রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন দুবলা শুটকিপল্লির জেলেরা। রাসায়নিক মুক্ত হওয়ায় দুবলার চরের শুঁটকির খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে।