শিকলে বাঁধা আসাদুল ও হা‌বিবু‌রের দুর্বিষহ জীবন

কুড়িগ্রামের উলিপুরে মানসিক ভারসাম্যহীন আসাদুল হক (৩৫) ও হা‌বিবুর রহমা‌নের (১৫) জীবন কাটছে শিকল বন্দী অবস্থায়। অসহায় পরিবার দুটি তাদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। উপজেলার তবকপুর ও ধামশ্রেনী ইউনিয়নে গেলে দেখা মেলে তাদের।

দুজনের মধ্যে, এক সময় ঢাকায় চাকরি করতেন সৌখিন আসাদুল হক (৩৫)। স্ত্রী নিয়ে সুখের সংসার ছিল তার। কিন্তু এখন তার জীবন চলছে মাসের পর মাস শিকল বাঁধা অবস্থায়। শিকল বাঁধা দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে অবুঝ শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ।

আসাদুল হকের বাড়ি উপ‌জেলার তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্ল্যা সরকা‌র পাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম দেলবর হোসেন। পেশায় চা বিক্রেতা। সহায় সম্বল বল‌তে ৭ শতক বসত‌ভিটা ছাড়া তার আর কিছু নেই। বাবার দারিদ্র্যতার কারণে ছেলের সঠিক চিকিৎসা করাতে না পারায় অসুস্থ জীবনযাপন করছে আসাদুল। ছেলের চিকিৎসার চিন্তা এখন বাবার কাছে বিলাসিতার সমান। তাই একমাত্র ছে‌লের এমন করুণ পরিণ‌তি‌তে হতাশ তি‌নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেলবর হোসেনের চার ছে‌লের-মে‌য়ে‌র ম‌ধ্যে ছোটবেলায় এক ছে‌লে ও এক মেয়ে মারা যায়। বর্তমানে আসাদুল ও এক মে‌য়ে র‌য়ে‌ছে তার। মে‌য়ের বি‌য়ে দিয়েছেন। মেয়ে স্বামীর ঘরে সংসার করছে। একমাত্র ছে‌লে আসাদুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া‌লেখা ক‌রে ঢাকায় গা‌র্মেন্ট‌সে (পোশাক কারখানায়) চাক‌রি কর‌তেন। চাকরিরত অবস্থায় তা‌কে বিয়ে দেওয়া হয়। বি‌য়ের কিছু‌দিন পর তার স্ত্রী বাবার বা‌ড়িতে চলে গি‌য়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়। ‌কিন্তু আসাদুল সেটা কিছুতেই মান‌তে পা‌রে‌নি। এরপর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে তিনি। তারপর আরও দুবার বি‌য়ে দি‌লেও কোনো স্ত্রী আসাদুলের সংসার করেনি। এরম‌ধ্যে আসাদু‌লের মা মারা যায়। এরপর থে‌কেই পুরোপু‌রি মানুসিক ভারসাম্যহীন হ‌য় পড়েন তিনি। সুযোগ পেলেই বা‌ড়িঘর ভাঙচুর, প্রতি‌বে‌শীদের জি‌নিসপত্র ক্ষ‌তি ক‌রেন এবং বাসা থেকে বের হয়ে যান।

দেলবর হোসেন জানান, স্ত্রী মারা যাওয়ার প্রায় ১০ বছর হয়। বাপ-ছে‌লে মিলে সংসার। ছোট চা‌য়ের দোকান দি‌য়ে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার ম‌তো আয় হয়। তা দি‌য়েই কোনরকমভাবে বাপ-ছে‌লে খাই। মানু‌ষের কা‌ছে ধার‌দেনা ক‌রে রংপু‌রে চি‌কিৎসা করাইছি। ডাক্তার কইছে (বলছে) ভা‌লো হইবে (হবে)। কিন্তু আমার ছে‌লে তো ভা‌লো হয় না। তি‌নি আরও জানান, এর আগে ক‌য়েকবার পা‌য়ে শিকল লাগা‌লেও মা‌ঝে ম‌ধ্যে খু‌লে দেওয়া হতো। কিন্তু প্রায় দুই বছর তার পা‌য়ের শিকল লাগা‌নো র‌য়ে‌ছে। আগের থে‌কে পাগলামীর মাত্রাটা এখন আরও বে‌ড়ে গে‌ছে।

এদি‌কে, প্রায় চার বছর ধ‌রে শিক‌লে আট‌কে আছে হা‌বিবুর রহমা‌নের জীবন (১৪)। হা‌বিবুর উলিপুর উপ‌জেলার ধাম‌শেনী ইউনিয়‌নের পোদ্দার পাড়ার দিনমজুর আবু‌দ্দির ছে‌লে। ১০ বছ‌র বয়‌সে সে মান‌সিক ভারসাম্য হা‌রি‌য়ে ফে‌লে। ৬ বছর আগে তার মা জো‌বেদা বেগম মারা যান। এরপর বাবা আবু‌দ্দি দ্বিতীয় বি‌য়ে কর‌লে সৎ মা‌য়ের স‌ঙ্গে থাকে হা‌বিবুর। প্রতি‌দিন কা‌জে বের হওয়ার সময় হাবিবুরকে রাস্তার পা‌শে বাশ ঝা‌ড়ে শিক‌লে বেঁ‌ধে রে‌খে যান বাবা আবু‌দ্দি। রোদ বৃষ্টি মাথার উপর দি‌য়ে গে‌লেও তা‌কে যেন দেখার কেউ নেই।

হা‌বিবু‌রের স্বজন ও স্থানীয়দের স‌ঙ্গে কথা ব‌লে জানা গে‌ছে, ১০ বছ‌র বয়‌সে সে মান‌সিক ভারসাম্য হা‌রি‌য়ে ফে‌লে। এরপর থে‌কে মানুষ‌কে মার‌ধর, বিদ্যুতের খুঁটিতে ওঠাসহ নানা অস্বাভা‌বিক আচরণ শুরু ক‌রে। মা‌ঝে ম‌ধ্যে সবার অজা‌ন্তে দু চার‌দিন নিরু‌দ্দেশ ছিল। প‌রে নিরুপায় হ‌য়ে পা‌য়ে শিকল প‌ড়িয়ে রাস্তার ধা‌রে বাঁশ ঝা‌ড়ে বেঁধে রাখা হয় তা‌কে। গরিব বাবার প‌ক্ষে ভা‌লো চি‌কিৎসা দেওয়া সম্ভব না হ‌লেও স্থানীয় অ‌নেক ক‌বিরা‌জের ওষুধ খাইয়েছেন। তবুও হা‌বিবুর‌কে সুস্থ‌ করা সম্ভব হয়‌নি ব‌লেও জানান তারা।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ মোর্শেদ জানান, এ সমস্ত রুগীদের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখাতে হবে। তাহলে পরে রোগ কোন অবস্থায় আছে সেটি জানার পর চিকিৎসা করালে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Related Posts

Next Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Welcome Back!

Login to your account below

Create New Account!

Fill the forms below to register

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.