শহরজুড়ে যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে লাশ। ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ, কাদাজল, রাস্তাঘাটে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। সমুদ্রেও ভাসতে দেখা যাচ্ছে বহু লাশ। ঝড় ‘ড্যানিয়েল’ এবং বন্যাবিধ্বস্ত লিবিয়ার দেরনা শহর এখন ধ্বংসস্তুপ। এমন ভয়াবহ চিত্র দেখে আৎকে উঠছেন সেখানের বেঁচে যাওয়া বাসিন্দারা।
সমুদ্রের তীরে ভেসে আসছে একের পর এক লাশ। গত রোববার লিবিয়ার দেরনা শহরে প্রলয়ংকরী একটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রে ভেসে গিয়েছিলেন এই মানুষগুলো। এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ বলছে আরও ১০ হাজারের বেশি মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে। তবে দেশটির আল-বায়দা মেডিকেল কলেজের পরিচালক আব্দুল রহিম মাজিক দাবি করেছেন, মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের ঘরে পৌঁছতে পারে।
বুধবার রাতে দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেরনা শহরের রাস্তা-ঘাটে এখনো মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস ডেনিয়েলের আঘাতে দেরনা এলাকার অসংখ্য পরিবারের সব সদস্যই মারা গেছেন। বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রামীণ জনপদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা নিরূপণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের আকাশে এখন শুধুই আহাজারি। গত ৪ সেপ্টেম্বর গ্রিসের উপকূলে ভূমধ্যসাগরে তৈরি হয়েছিল ঝড় ‘ড্যানিয়েল’। এর ফলে ৫ এবং ৬ সেপ্টেম্বর গ্রিসে রেকর্ড বৃষ্টিপাত ঘটে। গ্রিসের জাগোরা গ্রামের একটি অংশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। যা প্রায় ১৮ মাসের বৃষ্টিপাতের সমতুল্য। থেসালি, মধ্য গ্রিসের অনেক অংশে ২৪ ঘণ্টায় ৪০০ থেকে ৬০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। প্রবল বৃষ্টির ফলে গ্রিসে ১৫ জনের প্রাণহানি হয়।
‘ড্যানিয়েল’ ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে লিবিয়ার দিকে অগ্রসর হয় এবং ক্রমে ‘মেডিকেন’ (মেডিটেরানিয়ান হারিকেন)-এ পরিণত হয়। ‘মেডিকেন’-এ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং মধ্য-অক্ষাংশের ঝড়ের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই ঝড় সাধারণত সেপ্টেম্বর এবং জানুয়ারির মধ্যে তৈরি হয়।
লিবিয়ার জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র জানিয়েছে, ১০ সেপ্টেম্বর তীব্র হয় ‘ড্যানিয়েল’। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অংশে ১৫০ থেকে ২৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যার। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত লিবিয়ার আল-বায়দাতে। সেখানে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৪০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
রোববার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে ‘ড্যানিয়েল’ আছড়ে পড়ে লিবিয়ার উপকূলে। ‘ড্যানিয়েল’-এর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে আল-বায়দা, আল-মার্জ, তোবরুক, বাতাহর মতো বেশ কিছু শহর। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেরনা এবং বেনগাজির।
দেরনায় বেশ কয়েকটি নদীবাঁধ রয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে তিনটি বাঁধ ভেঙে গেছে। পানির তোড়ে সমুদ্রে ভেসে গেছে বহু বাড়িঘর। এর জেরেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।
শহরের পানি বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রবল বৃষ্টির চাপে দেরনার ১২ কিমি দূরে উপরের বাঁধটি আগে ভেঙে পড়ে। সব পানি দেরনা থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাঁধটিতে এসে চাপ সৃষ্টি করে এবং সেটিও ভেঙে পড়ে। এর ফলে শহরটির বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
লিবিয়ার বিমানপরিবহণ মন্ত্রী এবং পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের জরুরি পরিস্থিতি কমিটির সদস্য হিচেম আবু চকিওত রয়টার্সকে বলেছেন, ‘সমুদ্রে, উপত্যকায়, ভাঙা বাড়ির নিচে সর্বত্র লাশ পড়ে রয়েছে। শহরের ২৫ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’
দেরনার ওয়াহদা হাসপাতালের ডিরেক্টর মহম্মদ আল-কাবিসি রয়টার্সকে বলেন, ‘শহরের দু’টি ভাগের মধ্যে একটিতেই এখনও পর্যন্ত এক হাজার ৭০০ জন মারা গেছেন। অন্যটিতে এই সংখ্যা ৫০০।’
পূর্ব লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওথমান আবদুলজলিল সোমবার দেরনা শহর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। অবস্থা দেখে শিহরিত মন্ত্রী জানান, দেরনা এখন ‘ভূতুড়ে শহর’। তিনি বলেন, ‘শহরের এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। বহু মানুষ এখনও প্লাবিত ঘরে বন্দি। না খেয়ে দিন কাটছে তাদের। ধসের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে আরও কয়েকশো দেহ। অনেকেই ভেসে গেছেন সমুদ্রে।’
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দ্য রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজের একটি প্রতিনিধি দলের প্রধান তামের রমজান মৃতের সংখ্যাকে ‘অসংখ্য’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং নিখোঁজের সংখ্যা আনুমানিক দশ হাজার বলে নিশ্চিত করেছেন।
লিবিয়ার ইমার্জেন্সি অ্যান্ড অ্যাম্বুলেন্স অথরিটির প্রধান ওসামা আলি জানিয়েছেন, শক্তিশালী কর্দমাক্ত স্রোতে উপত্যকার বাড়িগুলো স্রেফ ভেসে গেছে। সঙ্গে যানবাহন ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ। শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে, ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর ফলে ব্যাপক উদ্ধার প্রক্রিয়া ক্রমে জটিল হয়ে পড়ছে।
সংকট মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বেনগাজিতে ১৬৮টি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ইতালি উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য প্রতিরক্ষা দল পাঠাচ্ছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র।
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ ডিবেইবা জানিয়েছেন, ১৪ টন ত্রাণ সমেত একটি বিমান বেনগাজিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বন্যাবিধ্বস্ত দেরনাতে এখনও ত্রাণ পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
২০১১ সালে শাসক মুয়াম্মার গদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশবাসী। পতন হয় সরকারের। নেপথ্যে ছিল ন্যাটো বাহিনী। তারপর থেকে পূর্বে বেনগাজিকেন্দ্রিক প্রশাসন এবং পশ্চিমে ত্রিপোলিকেন্দ্রিক প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ চলছে। তার প্রভাব পড়েছে বন্যাবিধ্বস্ত পূর্ব লিবিয়ার উদ্ধারকাজে।