ডিজিটাল মাধ্যম নানাভাবে ব্যবহার করছে প্রতারকচক্র। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যম ব্যবহার করে নানা কৌশলে চলছে অপরাধ। অপরাধীদের লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকেই হচ্ছেন নিঃস্ব। আবার কেউ কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন যে, লোকলজ্জার ভয়ে প্রতিকার চাইতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন না। এরপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জমা রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। প্রায়ই ডিজিটাল অপরাধীরা ধরা পড়ছে। এরপরও কমছে না অপরাধের মাত্রা।
অষ্টম শ্রেণি পাশ সেন্টু দেবনাথ। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। মি. পলক এম নামে সে একটি ফেসবুক আইডি খোলে। আইডিতে সে নিজেকে প্রধান বিচারপতির পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে উল্লেখ করে। বন্ধুদের নজর কারতে সে সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পোস্টও করত। ফেসবুকে তার বন্ধু তালিকায় অধিকাংশই মেয়ে। সম্প্রতি এক তরুণীর সঙ্গে সে ফেসবুকে যোগাযোগ করে। একপর্যায়ে তার সঙ্গে চেটিং করে। ওই তরুণী এবং তার দুই আত্মীয়কে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে ওই তরুণী সিআইডির দ্বারস্থ হলে তাকে সিআইডি গ্রেফতার করে। গত রোববার গোয়েন্দা পুলিশ ৬ হ্যাকারকে গ্রেফতার করে। তারা প্রবাসীদের ইমো আইডি হ্যাক করে স্বজনদের কাছ থেকে নানা সমস্যার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত।
আবুল কাশেম নামে এক ব্যক্তি কাতারে থাকেন। তার ইমো আইডি হ্যাক করে প্রতারকরা তার ছোট ভাই নূর উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নানা সমস্যার কথা বলে ৬৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। ডিবি জানিয়েছে, এ চক্র এ পর্যন্ত ৫০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন প্রবাসীর স্বজনদের কাছ থেকে। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের নামে ভুয়া ফেসবুক পেজ ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল একটি চক্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সম্প্রতি এ চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে। সুজন তালুকদার ও আবিরা জাহান কলি নামে দুজনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে ডিবি। সুজন একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছে। আর কলি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা দুজন মিলে প্রতারণার জাল পেতেছিল। কলিকে দিয়ে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে কৌশলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত। মঞ্জুর মোরশেদ নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির সঙ্গে ২০১৮ সালে কলির ফেসবুকে পরিচয় হয়। এরপর থেকে কলি নানা কৌশলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে মঞ্জুর মোরশেদের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করে যখন হুমকি দেয়, তখন মঞ্জুর মোরশেদ বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।
এরপর তিনি তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতার করে ডিবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদ পেতে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে বেশি। ফেসবুকে ই-কমার্স পেজ খুলে বিশাল ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভোক্তার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য না পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া জমি লিজ, প্লট বিক্রি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, এমএলএস ব্যবসার আড়ালে প্রতারণা, পে-অর্ডার প্রতারণা, অনলাইন প্রতারণাসহ নানারকম প্রতারণা এখন নিত্যদিন ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অবস্থাটা এমন যেন প্রতি এক গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে একেকজন প্রতারক। তারা বলছেন, এদের খপ্পর থেকে দূরে থাকার একমাত্র মাধ্যম সচেতনতা।
সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার মো. গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, সম্প্রতি আমরা একটি চক্রের কয়েক সদস্যকে গ্রেফতার করেছি। এরা প্রবাসীদের টার্গেট করে ইমো আইডি হ্যাক করে প্রতারণা করে। আবার হ্যাকিংও এরা আরেকটি গ্রুপের কাছ থেকে শিখে এসেছে। আমরা সেই চক্রকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, লোভে পড়া যাবে না। অনলাইনে লোভের ফাঁদে যিনি পড়বেন, তিনিই ধরা খাবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ও অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন এবং নিজের পিন, ওটিপি নম্বর কাউকে না দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তাছাড়া কেউ প্রতারকচক্রের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশকে অবহিত করার আহ্বান জানান তিনি।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ডিজিটাল প্রতারকরা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে প্রতারণার টোপ দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত প্রতারকচক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে। যতটা গ্রেফতার হচ্ছে, এর অনেক গুণ বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এদের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, র্যাবের হাতে বহু প্রতারকচক্র গ্রেফতার হয়েছে। চাকরির নামে, অনলাইনে ব্যবসা করার নামে প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। এদের র্যাব গ্রেফতার করছে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ডিজিটাল প্রতারণার শিকার মানুষের ৭০ ভাগই মামলা করতে চান না। আবার মামলার পর গ্রেফতার করা হলেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠছে চক্রের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুধু রাজধানীতেই কম করে হলেও ৫ শতাধিক প্রতারক সক্রিয় রয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৫ হাজারের বেশি প্রতারক। এর মধ্যে ডিজিটাল প্রতারকই বেশি। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার স্পেস ব্যবহার করে বভিন্ন অপরাধের জন্য প্রতিনিয়তই মামলা হচ্ছে, গ্রেফতারও হচ্ছে আসামি।
তবুও যেন পেরে ওঠা যাচ্ছে না সাইবার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। তারা বলছেন, অপরাধীরা জেনেশুনে টাকা আয়ের লক্ষ্যে অপরাধ করছে। আর সাইবার স্পেস ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনবিজ্ঞরা তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) এক জরিপে বলা হয়েছে, সাইবার অপরাধের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩.৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮.৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪.৫২ শতাংশ বেশি। গত বছরের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬.৩১ শতাংশ। কিন্তু এ বছর তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮.৬৭ শতাংশ। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ গতবার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল। এবারের জরিপে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে।