হঠাৎ করেই দেশে বেড়েছে প্রতারণা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৭৮টি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে শুধু ঢাকা মহানগরে। বেশিরভাগ ঘটনায় দেখা গেছে প্রতারক চক্রগুলো টার্গেট করছে স্বল্পশিক্ষিত, চাকরি প্রত্যাশী ও বেকার মানুষদের। তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। লোভের ফাঁদে পড়েই অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন।
কদিন আগেই সামনে আসে ‘বনবন্ধু’ জাহিদুর রহমান ইকবালের প্রতারণার ঘটনা। মুজিব বর্ষের লোগো, প্রধানমন্ত্রীর বাণী সম্বলিত প্যাডে ৪০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়ে গাছ লাগানোর কথা বলেন জাহিদুর। নিজেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করতেন তিনি। অভিযোগ আছে, ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেও অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কাওরান বাজারের শাহ আলী ভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ।
এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসে আরও বেশ কয়েকটি প্রতারক চক্রকে আটক করেছে পুলিশ। চলতি মাসের শুরুতেই অর্থাৎ গত মঙ্গলবার একটি প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। অন্যদিকে ভাগ্য বদলানোর কথা বলে বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণার অভিযোগে মানবপাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে সিআইডি। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক স্বল্প শিক্ষিত লোকদের টার্গেট করতো এই চক্রটি। তারা ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করতো।
আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগের দ্বিগুণ টাকা লাভ দেওয়ার প্রলোভনে মানুষের কাছ থেকে ৫৭ কোটি হাতিয়ে নেয় একটি প্রতারক চক্র। এ প্রতারক চক্রটিকে গ্রেফতারের পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক। এ চক্রটির হাতে প্রতারিত একজন ভুক্তভোগী ঝিনাইদহের মহেশপুর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নাসির উদ্দিন। প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা মুনাফার আশায় দুই লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন ভুয়া নামে এমএলএম একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি আমার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেয়। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে আমাকে সাড়ে আট হাজার টাকা মুনাফা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার কোনো টাকা না পেয়ে আমি অসহায় হয়ে তাদের অফিসে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। আমি এর ন্যায় বিচার চাই।
দ্বিগুণ মুনাফার আশায় রাজধানীর বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী রুস্তমও একই পন্থায় টাকা দিয়েছিলেন এ চক্রটিকে। তারও একই পরিণতি হয়েছে। এদিকে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা লোন নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগে গত মঙ্গলবার (২ মার্চ) রাজধানীর খিলগাঁও ও রামপুরা এলাকা থেকে ৬ জন প্রতারককে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে ঢুকে জাতীয় পরিচয়পত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তির তথ্য ঠিক রেখে পাল্টে ফেলত ছবি। তা দিয়ে তৈরি করা হতো ভুয়া টিন সার্টিফিকেট ও ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স। এসব ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক লোন তুলে পালিয়ে যেত এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা।
ইদানিং কেন প্রতারণা বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, লোভের ফাঁদে পড়েই অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারক চক্রগুলো বড় বড় লোভনীয় অফার দিচ্ছে, সাধারণ মানুষজন না বুঝেই তাদের কথায় রাজি হচ্ছে। দেখা গেছে একটি ফ্ল্যাট বা একটি জমি একাধিক লোকের কাছে বিক্রি করছে। গ্রাহকরা না বুঝেই অগ্রিম টাকা দিচ্ছে এবং আর ফেরত পাচ্ছে না। ২ শতাংশ ভুক্তভোগী ফেরত পেলেও বাকিরা পাচ্ছে না। লেনদেন করার সময় তো সতর্ক থাকে না।
মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে ভুয়া এনআইডি কার্ড, টিন সার্টিফিকেট ও ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ করা। কিছু প্রতারক চক্র ফ্ল্যাট কেনার নামে কৌশলে ফ্ল্যাটের প্রকৃত মাকিলের কাছ থেকে তার এনআইডি কার্ড এবং ফ্ল্যাটের সমস্ত কাগজপত্র হাতিয়ে নিয়ে সব তথ্য ঠিক রেখে শুধু ছবি বদল করে নকল কাগজপত্র তৈরি করছে। নকল কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের লোন বাগিয়ে নিচ্ছে। যারা ব্যাংকে কাজ করেন তাদের আরও সতর্ক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানাবো। প্রয়োজনে বার বার মূল কাগজ যাচাইবাছাই করা হোক। তাদের সার্ভারগুলো আরও কিভাবে নিরাপদে রাখা যায় এসব নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অপরাধের আরেকটি বড় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে সাইবার অপরাধ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা নেই। ফলে না বুঝেই ইন্টারনেটে অনেক কাজ করে পরে বিপদে পড়ছে, পড়ছে প্রতারকদের খপ্পরে। যেকোনো লেনদেনে সবাইকে যথেষ্ট সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে এ পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিগত কোনো কিছু সরবরাহ করা বা অর্থনৈতিক লেনদেন করার আগে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ভালোভাবে জেনেশুনে তারপর লেনদেন করতে হবে। কাগজপত্র প্রয়োজনে বার বার ক্রস চেক করতে হবে। কোনো সন্দেহ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে।