তিন স্তরের (মহানগর, বিভাগ ও জেলা) সরকারি-বেসরকারি হাইস্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে হযবরল অবস্থা তৈরি হয়েছে। কোথাও বেশি বয়সের ধুয়া তুলে লটারিতে নির্বাচিতদের ভর্তি করানো হচ্ছে না। কোথাও আবার মৌখিক পরীক্ষার নামে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এর ফলে লটারিতে চান্স পাওয়ার পরও কেউ কেউ ভর্তি থেকে বাদ পড়ছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরের কাছে এসব বিষয়ে তথ্যবহুল অভিযোগ করেছেন। অপরদিকে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) আয়োজনে অনলাইনে আবেদনকারীদের মধ্যেই এমন শিক্ষার্থী আছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। অবশ্য এসব শিক্ষার্থীকে এখন সরাসরি ভর্তির সুযোগ দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভর্তির এই সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, ‘ভর্তির নামে যুদ্ধাবস্থা দূর করার জন্য সরকার লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে। তাই লটারির বাইরে মূল্যায়ন বা অন্য কোনোভাবে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কিংবা ছাঁটাইয়ের সুযোগ নেই। লটারিতে সুযোগ পেলে ভর্তি বাধ্যতামূলক। কিন্তু যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লটারিতে চান্স পাওয়ার পরও ভর্তি না করার অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে অভিভাবকরা লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মোদ্দা কথা কেউ ভর্তিবঞ্চিত থাকবে না। যারা লটারিতে চান্স পায়নি কিংবা অনলাইনে আবেদন করতে পারেনি-তাদের সরাসরি ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে। আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে এই ভর্তি প্রক্রিয়ার বিষয়টি স্ব স্ব স্কুল সরকারি কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করবে।’
ভর্তিতে দুর্নীতি বন্ধে এবার প্রথমবারের মতো বেসরকারি হাইস্কুলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় লটারিতে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জেলা সদর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড় দিয়েছে। অর্থাৎ লটারি না করেও নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি করাতে পারবে। এ ধরনের স্কুলের মধ্যে বিভিন্ন চার্চ পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসহ ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল ও উত্তরা মডেল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান আছে। যদিও অভিভাবকদের দাবি অনুযায়ী এসব স্কুলে যেহেতু ভর্তি নিয়ে বেশি তদবির হয়, তাই এখানে লটারিতে ভর্তি রাখা জরুরি ছিল।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, মাউশির কমিটির অধীনে এবং কেবল লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও স্বতন্ত্র ভর্তির অনুমতি পাওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেছে। এক্ষেত্রে কোনোটি লটারির আগে, আবার কোনোটি লটারির পরে মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক জানান, এই প্রতিষ্ঠানটি এবার কেন্দ্রীয় ভর্তি প্রক্রিয়ায় আসেনি। নিজেরা আবেদন নিয়ে গত শনিবার তৃতীয় শ্রেণির লটারি আয়োজন করে। রোববার থেকে শিক্ষার্থীর কাগজপত্র যাচাই করে ভর্তি নেওয়ার কথা। কিন্তু ঘোষণার বাইরে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ভর্তিবঞ্চিত করা হয় অনেককে। ওই অভিভাবক আরও বলেন, তার সন্তানও আছে বঞ্চিতদের ওই তালিকায়। তার সন্তানের ভর্তির তারিখ ছিল সোমবার। তাদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। সারাদিন না খেয়ে থাকায় সন্ধ্যায় ছেলে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। পরে দেখে তার ছেলেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ লটারিতে নির্বাচিত কাউকে বাদ দেওয়ার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মাউশির পরিচালক অধ্যাপক মো. বেলাল হোসাইন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি আলাদা ভর্তির অনুমতি পেলেও কোনো ধরনের পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও লটারিতে নির্বাচিতদের ভর্তিতে জটিলতা হয়েছিল। জামালপুর জিলা স্কুলে লটারিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বয়সের জটিলতার কারণে শিক্ষার্থী ভর্তি না করার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আন্দোলন করেন। পরে অবশ্য মাউশি নির্দেশনা জারি করে যে, কেবল প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ৬ বছর বা এর বেশি বয়স হতে হবে। তবে এর কম হলে হলে ভর্তি করা হবে না। আর অন্য শ্রেণিতে বয়সের কোনো বিধিনিষেধ নেই।
মাউশি সূত্র জানায়, এবার ৪০৫টি সরকারি এবং ২৯৬২টি বেসরকারি স্কুলে সরকারিভাবে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। এগুলোর মধ্যে সরকারিতে ৮০ হাজার ১৭টি এবং বেসরকারিতে ৯ লাখ ৪০ হাজার ৮৭৬টি আসন রয়েছে। ৮০ হাজার আসনের বিপরীতে আবেদন পড়ে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৩টি। আবেদনকারী বেশি থাকা সত্ত্বেও ৪ হাজার ৪৮ আসনে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া যায়নি। অপরদিকে বেসরকারি আসনের তুলনায় আবেদন কম পড়লেও সবাইকে ভর্তির সুপারিশ করা হয়নি। আবেদনকারীর মধ্যে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৬৪১ জন লটারিতে চান্স পেয়েছে। মোট আবেদন করেছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৭ জন। সুপারিশ বঞ্চিত আছে ৯২ হাজারের বেশি। ফলে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারিতেও ভর্তি নিয়ে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আবেদন করে ৯ লাখ ৬ হাজার ৮৬০ জন। তাদের মধ্যে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ভর্তির সুপারিশ পেয়েছে। বাকি সাড়ে ৫ লাখেরই ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তারা এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে এক রকম হন্যে হয়ে ভর্তি করাতে বিভিন্ন স্কুল খুঁজছে। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণিতে আবেদনকারীরা বেশি অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
রাজধানীর মতিঝিলের বাসিন্দা মেহেদী হাসান রাসেল বলেন, ‘তার দুই ছেলে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন। ছোটটি প্রথম শ্রেণিতে আর বড়টি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। কিন্তু ফলাফলে দুই ছেলেই অপেক্ষমাণ তালিকায় আছে। তবে বড়টি নিয়ে ঝামেলা নেই। তাকে হয়তো আগের স্কুলে রাখা যাবে। কিন্তু ছোটটি নিয়ে তিনি বিপদে পড়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘লটারি প্রক্রিয়া না থাকলে তিনি তার ছেলেকে হয়তো পছন্দের ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারতেন।’
এদিকে মাউশির উপপরিচালক আজিজ উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘ভর্তির জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আসন আছে। যদিও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন কম। কিন্তু বেসরকারিতে সাড়ে ৯ লাখ আসন আছে। লটারির মাধ্যমে পৌনে ৩ লাখকে সুপারিশ করা হয়েছে। সুতরাং শূন্য আসনে এখন স্কুল না পাওয়া, এমনকি অনলাইনে আবেদন না করা প্রার্থীরা ভর্তি হতে পারবে। এজন্য এখন সরাসরি ভর্তি করার অনুমতি স্কুলগুলোকে দেওয়া হবে।
মাউশি পরিচালক বেলাল হোসাইন বলেন, ‘মূলত জানুয়ারি মাস ধরেই শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম চলবে। যারা লটারিতে এসেছে কিংবা আসেনি- সবার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে ৪ হাজার আসন শূন্য আছে সেখানে স্কুলগুলোর চাহিদার ভিত্তিতে দ্বিতীয় তালিকায় শিক্ষার্থী দেওয়া হবে। আর নানান কারণে সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যেও কেউ কোথাও ভর্তি না হওয়ায় আসন শূন্য হলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি করানো হবে। এরপরও আসন খালি থাকলে দ্বিতীয় অপেক্ষমাণ তালিকা দেওয়া হবে।’