ঈদকে সামনে রেখে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ ৯ দিনের জন্য শিথিল করেছে সরকার। এটা মানতে পারছেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলছেন, শিথিলতার এ নির্দেশনায় তাদের ‘সায়’ ছিল না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র। এ সময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ারই শামিল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর যেখানে বারবার ভিড় এড়িয়ে চলার কথা বলছে, সেখানে সংক্রমণের ‘পিক টাইম’-এ এ ধরনের ঘোষণা আমাদের আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে। তারা বলছেন, গণপরিবহন, শপিং মল, কোরবানির হাট, কোরবানির সামাজিকতা-এগুলো সংক্রমণ বাড়িয়ে দেবে। ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকেই এর পরিণতি দেখা যাবে। মৃত্যু অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে এ মাসের শুরুতে আরোপিত বিধিনিষেধগুলো ঈদুল আজহা উপলক্ষে শিথিল করলো সরকার। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) থেকে ৯ দিন বিধিনিষেধ শিথিল রাখার কথা জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদ পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে আগামী ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত আগের আরোপিত সকল বিধিনিষেধ শিথিল করা হলো।’
সর্বোচ্চ শনাক্তের পরদিনই শিথিল!
দেশে করোনা সংক্রমণের দেড় বছরের মাথায় একদিনে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের পরদিনই এলো বিধিনিষেধ শিথিল করার ঘোষণা। একে ছলনা বলে উল্লেখ করেছে খোদ পরামর্শক কমিটির সদস্যরা। ১৩ জুলাই বিকেলে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে একদিনে শনাক্ত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯৮ জন। ১২ জুলাই শনাক্ত হন ১৩ হাজার ৭৬৮ জন। যা কিনা মহামারিকালে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ।
পরামর্শক কমিটি বলছে, এসময় আমাদের আরও কঠোর হওয়ার কথা থাকলেও একে একে সব খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমরা হতভম্ব। কারণ আমাদের জনগণ স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই মানে না। মাস্ক পরা আমরা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি। সংক্রমণের এই মুহূর্তে শিথিলতা আগামীর দিনগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কাজ করোনা মোকাবিলায় যা ভালো সেটা বলা। আমরা সেটাই করি। এরপর সরকার তার বিবেচনাপ্রসূত কাজ করছে। এখন পর্যন্ত করোনার নিম্নমুখী ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে না। লকডাউনটা ধরে রাখতে পারলে হয়তোবা দেখতাম। এক সপ্তাহ পর কিছুটা কমতো। হয়তো শনাক্তের হার ২৫-এর নিচে ও মৃত্যু ১৫০-এর নিচে কমে আসতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর মধ্যে সব খুলে দেওয়া হলো। মানুষ এতদিন ঘরে ছিল বলে অনেকেই বের হবে একসঙ্গে। শতভাগ মানুষ মাস্ক পরছে না-এটা আমরা দেখে ফেলেছি, জেনে গেছি। তারা যখন একসঙ্গে বের হবে তখন ভাইরাস তার কাজ করে যাবে। একজন থেকে আরেকজনে ছড়াবে। যে কারণে আমাদের পরামর্শ ছিল- কঠোর বিধিনিষেধ আরও দুই সপ্তাহ চালানো। এতে ভালো অবস্থানে যেতে পারতাম।’
‘জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা এই শিথিল হওয়াকে হুমকি হিসেবে ধরছেন’ জানিয়ে কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ প্রজ্ঞাপনে আমরা বিস্মিত, হতভম্ভ। সব খুলে দেওয়া হলো ৯ দিনের জন্য। সরকার বলছে, শিথিল করা হলো। অথচ সব আগের অবস্থায় চলে যাবে।’
তিনি শিথিল এই বিধিনিষেধকে তুলনা করেছেন ‘ছলনা’র সঙ্গে। বলেন, ‘আগামী ১০ দিনের শিথিলতায় বর্তমান অবস্থার আরও অবনতি যে ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই।’ কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একদিনে মৃত্যু ২০০ পার করছে। শিথিলতার কারণে সংক্রমণ আরও বাড়বে। নিশ্চিতভাবেই বাড়বে মৃত্যু।’
‘যা হওয়ার সেটাই হবে’ জানিয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ মুহূর্তে আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বললেন, ‘এখন সবাই সংক্রমিত হবো। কিছু হয়তো বেঁচে যাবেন। যারা এ দফায় সারভাইব করতে পারবেন না, তাদের হারাতে হবে।’
‘শিথিল বিধিনিষেধ’ সংক্রমণ আরও বাড়াবে জানিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ১৪ দিনের সর্বাত্মক বিধিনিষেধের ফলাফল দেখতে এখনও অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমাদের। যা এখনও দৃশ্যমান নয়। আমি আশাবাদী ছিলাম, সংক্রমণ হয়তো কমতে শুরু করবে এর মধ্যে। সেটা তো হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে আজকেই শিথিল হয়ে গেছে। ৯ দিন একটানা সব ছেড়ে রাখাটা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ারই শামিল।’