ইসি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এসব রোহিঙ্গা অর্থ বিনিময় চক্রের সাহায্য নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং অনেকে তা পেয়েও যাচ্ছে। আবার তাদের ধরা হচ্ছে এবং এগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে এ সমস্যার একটি চিরস্থায়ী সমধানের জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারে (ইউএনএইচসিআর) কাছে থাকা রোহিঙ্গাদের ডাটা বেইজ ব্যবহার করতে চায় ইসি। এতে করে রোহিঙ্গাদের আঙুলের ছাপ দিয়েই তাদের শনাক্ত করা যাবে এবং রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার যে প্রবণতা তা অনেকটাই হ্রাস পাবে।
এ বিষয়ে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর ঢাকা মেইলকে বলেন, কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা সেখানে বললাম, রোহিঙ্গাদের ডাটাবেইজ যদি পাওয়া যায় তাহলে সহজেই তাদের চিহ্নিত করা যাবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, যে সময় রোহিঙ্গারা আমাদের এখানে এসেছিল ওই সময় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) আঙুলের ছাপসহ রোহিঙ্গাদের একটি ডাটাবেইজ তৈরি করেছিল, যা ইউইনএইচসিআরের কাছে আছে, কিন্তু আমাদের কারো কাছে এ ডাটাবেইজটা নেই। এখন আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি ইউএনএইচসিআরকে বলে দেওয়ার জন্য, যাতে ডাটাবেইজটা আমাদের দেয়। এই ডাটাবেইজ পেলে রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার ঝুঁকিটা কমে যাবে। আমরা এই ডাটাবেইজটা পাওয়ার চেষ্টা করছি।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দশ লাখের বেশি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে।
জানা যায়, বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলের নাগরিকদের এনআইডি সেবা সহজ করতে এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত ঠেকাতে তিনটি ক্যাটাগরিতে নাগরিকদের আবেদন ভাগ করে নিয়ে নিষ্পত্তি করে থাকে সংস্থাটি। কেউ আবেদন করলে প্রথমে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ফেলার কথা বলা হয়েছে। দুটি ক্যাটাগরির কোনোটিতেই না চিহ্নিত করা না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন ‘সি’ ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে পাঠাতে বলা হয়েছে। আবার কেউ আবেদন করলেই যেন রোহিঙ্গা সন্দেহ না করা হয়, সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে থেকে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, যাদের এসএসসি/সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ আছে এবং পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে তথ্যের মিল থাকবে তারাই ‘এ‘ ক্যাটাগরিতে পড়বেন। আবার এসএসসি/সমমান বা তদূর্ধ্ব সনদ থাকবে না কিন্তু অনলাইন জন্ম সনদ ও পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে তথ্যের মিল থাকবে তারা ‘বি’ ক্যাটাগরিতে পড়বেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যেসব আবেদনে সন্দেহ হবে সে আবেদনগুলো ‘সি’ ক্যাটাগরি বা বিশেষ কমিটির কাছে চলে যাবে।
বিশেষ কমিটির কার্যপরিধি
১। বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত সকল জাতীয় পরিচয়পত্রের এনআইডি নম্বরসমূহ অনলাইনে যাচাই করতে হবে। যাচাইয়ের সময় নিম্নলিখিত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে-
(ক) ভাই/বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের সাথে আবেদনকারীর উল্লিখিত পিতা/মাতার নামের মিল থাকতে হবে।
(খ) চাচা/ফুফুর ডাটাবেজে তাদের পিতার নাম ও ঠিকানার সাথে আবেদনকারীর বিশেষ তথ্য ফরমে প্রদত্ত পিতামহের নাম ও ঠিকানার মিল থাকতে হবে।
(গ) প্রয়োজনে নিকটাত্মীয়ের মোবাইল নম্বরে কথা বলে তাদের পরিচিতি/তথ্য সম্পর্কিত বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
২। ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ভোটার হতে ইচ্ছুক উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের কোথাও ‘সচরাচর নিবাসী’ হতে হবে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারিকৃত পরিপত্রে উল্লিখিত জেলাসমূহের যদি কেউ সচরাচর নিবাসী দাবি করে, তবে সেই দাবির যথার্থতা পুঙ্খানুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করতে হবে। শুধু একটি নিবাসের ঠিকানাই এজন্য যথেষ্ট হবে না। নিবাসের প্রমাণস্বরূপ তাকে এ সংক্রান্ত প্রণীত অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ ফরম অনুযায়ী চাহিত সব তথ্য প্রদান করতে হবে।
৩। যদি বর্ণিত জেলাসমূহে এই সমস্ত ব্যক্তি নিজস্ব সম্পত্তির সূত্রে তালিকাভুক্তির দাবি করে তবে তাদের সম্পত্তির মালিকানা ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য সংশ্লিষ্ট দালিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।
৪। যারা বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের সাথে বৈবাহিক সূত্রে ভোটার তালিকাভুক্তির দাবি করবেন তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত নাগরিক সনদপত্রসহ দলিলাদি তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে এবং অন্য কোনো সূত্রে কেউ ভোটার হওয়ার উপযুক্ত দাবি করলে তাদেরকে এ সম্পর্কিত প্রমাণ তথ্য সংগ্রহকারীকে প্রদান করতে হবে।
৫। তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম-২ এর সাথে এ কার্যক্রমের আওতায় অতিরিক্ত তথ্য ফরম মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় দালিলিক কাগজপত্রসহ প্রতিটি কেস উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারের কাছে জমা দেবেন। উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার আবেদন/কেসসমূহের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করে সকল কাগজপত্র বিশেষ কমিটির নিকট উপস্থাপন করতে হবে।
৬। বিশেষ কমিটি প্রতিটি ফরম পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাইয়ের আগে সিদ্ধান্ত দেবেন। বাছাইকৃত কেসগুলোয় বিশেষ কমিটির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসারকে অবহিত করার পর তিনি ওই সমস্ত নাগরিকদের ভোটার তালিকাভুক্ত করার জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণের আগে নিবন্ধন কেন্দ্রে তাদের আগমনের জন্য নোটিশ জারি করতে হবে। যাদের কেস গ্রহণ করা হবে না, কী কারণে গ্রহণ করা হলো না, তা নোট শিটে লিপিবদ্ধ করে বিশেষ কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর করতে হবে। এছাড়া নিষ্পত্তির বিষয়টি প্রতিটি বিশেষ তথ্য ফরম (ফরম-২ এর অতিরিক্ত তথ্য)-এর ১৬ নম্বর ক্রমিকে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্ত উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৭। বিশেষ কমিটি যাদের আবেদন বাতিল করবে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর উক্ত বিষয়ে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তের অনুলিপি নিয়ে সংশোধনকারী কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন কতে পারবেন।
৮। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে যদি কেউ তাদের সহযোগিতা অথবা মিথ্যা তথ্য প্রদান অথবা মিথ্যা/জাল কাগজপত্র সরবরাহ করেন অথবা সংশ্লিষ্ট কারো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে হবে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা সমতলে ছড়িয়ে পড়ায় ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার সব উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করে ইসি। ৩২টি উপজেলা/থানার ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের নিবন্ধনের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘বিশেষ কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটির যাচাই-বাছাই এবং সুপারিশ প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়।