প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আইনি বিতর্ক শুরু হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মোট চারটি ধারায় মামলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ৩ ও ৫ ধারা এবং ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯/৪১১ ধারা। একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক আমলের শতবর্ষের এই আইনে মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা না নিয়ে একটি অপ্রচলিত পুরনো আইনে মামলা করায় প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন সংবাদকর্মীর নামে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা করায় আইনের অপব্যবহার হয়েছে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন ১৯২৩ এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, (১) যদি কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থি উদ্দেশ্যে (ক) কোনও নিষিদ্ধ এলাকায় গমন করে, পরিদর্শন করে, অতিক্রম করে সান্নিধ্যে আসে অথবা ভেতরে প্রবেশ করে, অথবা (খ) কোনও স্কেচ, প্ল্যান, মডেল অথবা নোট তৈরি করে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শত্রুপক্ষের উপকারে আসবে বলে মনে হয়, ধারণা করা যায় অথবা নিশ্চিত হওয়া যায়, অথবা (গ) যদি কোনও ব্যক্তি শত্রুপক্ষের ব্যবহারে আসতে পারে, আসবে বলে ধারণা করা যায় অথবা নিশ্চিত হওয়া যায়, এমন কোনও অফিসিয়াল গোপন কোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনও দলিলপত্রাদি অথবা তথ্য আহরণ করে সংগ্রহ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনও ব্যক্তির কাছে পাচার করে, তাহলে সেই ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।
(২) ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান সম্বলিত এই ধারায় অভিযোগ আনার জন্য অভিযুক্ত যেকোনও একটি বিশেষ কার্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থিমূলক উদ্দেশ্যে করেছে, তার প্রমাণ প্রয়োজন নেই এবং উক্ত বিশেষ কার্যটি তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও, এই ধারায় তাকে শাস্তি প্রদান করা যাবে। যদি মামলার অবস্থা অথবা তার আচরণ অথবা তার জ্ঞান কার্যাবলী প্রমাণ করে যে, তার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যাহত অথবা নিষিদ্ধ এলাকা সম্পর্কিত কোনও বিষয়ের কোনও স্কেচ, ধান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিল বা তথ্য অথবা কোনও গোপনীয় কোড বা পাসওয়ার্ড তৈরি, আহরণ সংগ্রহ, রেকর্ড ও প্রকাশ করে বা আইনগত অধিকার প্রাপ্ত না হয়ে পাচার করে।
যদি মামলার অবস্থা, তার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থি তাহলে ধরে নিতে হবে যে, উক্ত স্কেচ, গান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্র অথবা তথ্য তৈরি, আহরণ সংগ্রহ, রেকর্ড, প্রকাশ ও পাচার করা হয়েছে-রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থিমূলক উদ্দেশ্য। ৩ (ক) এ ধারার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অপরাধটি বিদেশি শক্তির স্বার্থে বা প্রয়োজনে করা হয়েছে বলে ধারণা করা গেলে বা প্রমাণিত হলে অথবা অপরাধটি প্রতিরক্ষা সম্পর্কীয় বা গোপন অফিসিয়াল কোড সম্পর্কিত হলে, মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, এবং (খ) অন্যান্য ক্ষেত্রে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
একই আইনের ৫ ধারায় তথ্যের বেআইনি হস্তান্তর সম্পর্কে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে- (১) কোনও নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনও এলাকা সম্পর্কীয় কোনও গোপনীয় অফিসিয়াল কোড বা পাসওয়ার্ড বা স্কেচ, প্ল্যান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্রাদি অথবা তথ্যাদি কোনও ব্যক্তি আইনসঙ্গত দখলে বা নিয়ন্ত্রণে থাকলে। (ক) সে যদি তা ইচ্ছাকৃতভাবে, আইনগত অধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি বা আদালতের কাছে বা রাষ্ট্রের স্বার্থে অন্য কোনও ব্যক্তির নিকট ব্যতীত, অন্য কোনও ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে, অথবা; (খ) তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের শক্তির স্বার্থে বা দেশের নিরাপত্তার পরিপন্থীমূলকভাবে ব্যবহার করে, অথবা; (গ) আইনগত অধিকারের মেয়াদ শেষেও যদি তা নিজের অধিকারে রাখে বা (ঘ) যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফেরত প্রদানের বা হস্তান্তরের নির্দেশ পালন না করে অথবা তা সংরক্ষণে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে বা নিজেই এর নিরাপত্তা পরিপন্থী কার্য করে, (ঙ) তা হলে সে এ ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।
(২) যদি কোনও ব্যক্তি ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে এ আইনের পরিপন্থি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে ১নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত তথ্যাদি গ্রহণ করে, সে এই ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।
(৩) এই ধারার অধীনে অপরাধী ব্যক্তি নিম্নরূপভাবে দণ্ডনীয় হবে- (ক) উপধারা (১) (এ) এর অধীন পরিপন্থি কার্যাধির বা কোনও প্রতিরক্ষা নির্মাণকাজ, অস্ত্রাগার, নৌ, স্থল বা বিমান বাহিনীর স্থাপনা বা স্টেশন বা খনি, মাইনক্ষেত্র, কারখানা, ডকইয়ার্ড, ক্যাম্প বা বিমান বা গোপনীয় অফিসিয়াল কোড সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হলে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদেশি শক্তির স্বার্থে বা সুবিধার্থে ব্যবহৃত হবে বলিয়া অনুমেয়। তা হলে বা ধারণ করা গেলে মৃত্যুদণ্ডে অথবা চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
(খ) অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা জরিমানা দণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এই আইনে অপরাধের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ এলাকায় গমনের কথা বলা হয়েছে। নিষিদ্ধ এলাকার সংজ্ঞায়নে সরকার কর্তৃক গেজেটের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে হবে। রোজিনার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, এই মামলাটি আইনত ত্রুটিপূর্ণ। এজাহারে কোনো ডকুমেন্টের রেফারেন্স নাই। জব্দ তালিকায় বর্ণিত ডকুমেন্ট আসামির দখল থেকে উদ্ধার করা হয়নি। এজাহারে বর্ণিত ঘটনায় নিষিদ্ধ কোনো ডকুমেন্টস নাই যাতে এই আইনে মামলা করা যায়। তাই এই মামলায় অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।
আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করছেন, এই আইনটি এই মামলায় ভুল প্রয়োগ হয়েছে। তিনি বলেন, অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ এলাকা থেকে হলে সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন থাকতে হবে এবং নিষিদ্ধ এলাকা বলে দরজায় নোটিশ টানিয়ে দিতে হবে। তাই এজাহার মতে এই মামলায় এই আইনের ভুল প্রয়োগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই মামলায় দণ্ডবিধির ৩৭৯/৪১১ ধারায় চুরি ও অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনের ৩/৫ ধারায় সরকারি গোপনীয় ডকুমেন্টস চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। দণ্ডবিধি অনুযায়ী চুরির বিষয়টি ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে হয়। আর অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জড়িত। দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্যে অপরাধ একই ঘটনায় হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সরকারি নথির গোপনীয়তা রক্ষায় হয় এই অফিসিয়াল সিক্রেটস আইন করা হয়। একজন সাংবাদিকের ওপর এই আইনে মামলা হওয়ার নজির বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।