ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু সহসাই এ যুদ্ধ থামবে এমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। না ইউক্রেন না রাশিয়া, না তাদের কোনও মিত্র, কারো পক্ষ থেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনও চিহ্নমাত্র নেই। কিয়েভ এ ব্যাপারে একরোখা যে তাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা বজায় থাকতে হবে এবং তারা রাশিয়ান সৈন্যদের হটিয়ে দেবে। অন্যদিকে, মস্কো তাদের অবস্থানে অনড় যে ইউক্রেন যথাযথ রাষ্ট্র নয় এবং তাদের লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ার সামরিক অভিযান চলবে।
কে জিতছে?
শীতকালজুড়ে তীব্র মুখোমুখি লড়াইয়ে, দু’পক্ষেরই বেশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন প্রায় ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে এবং ২০২২ সালের শরতের পর থেকে এই এলাকায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
দুই বছর আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রার সামরিক অভিযান শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই, ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ান সৈন্যদের রাজধানী কিয়েভ ও উত্তরাঞ্চল থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ওই বছরের শেষদিকে তারা পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলেও দখল করা বড় এলাকা উদ্ধার করে। কিন্তু এই মূহুর্তে রাশিয়ানরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আর ইউক্রেনীয়রা বলছে যে তাদের গোলা বারুদ ফুরিয়ে আসছে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চলা পূর্বাঞ্চলের আভডিভকা শহর থেকে নিজেদের সৈন্যদের সরিয়ে নেয় ইউক্রেন। যেটাকে একটা বড় বিজয় হিসেবে দেখে রাশিয়া – কারণ কৌশলগতভাবে আভডিভকা শহরটি আরও ভেতরে অভিযানের পথ খুলে দিতে পারে।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়া অভিযান শুরু করে, মিলিটারি ব্লগার এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা প্রচারণায় বলা হয় মাত্র ‘তিন দিনের মধ্যেই’ রাজধানী কিয়েভ দখল করা হবে, সেই তুলনায় এটা খুবই সামান্য অগ্রগতি।
বর্তমানে ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ অঞ্চল রাশিয়ার শক্তির নিয়ন্ত্রণে, যার মধ্যে ২০১৪ সালের মার্চে দখল করা ক্রাইমিয়া এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিরাট অংশও রয়েছে।
ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন কি কমে আসছে?
গত দুই বছর ধরে ইউক্রেনের মিত্ররা প্রচুর পরিমাণ সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সাহায্য দিয়ে আসছে – কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির হিসেবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯২ বিলিয়ন ডলার এসেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে, আর ৭৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাঙ্ক, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দূর পাল্লার আর্টিলারি ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহায়তার পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছে এবং ইউক্রেনকে আদতে কতদিন তাদের মিত্ররা সহায়তা চালিয়ে যেতে পারবে, সে নিয়ে আলোচনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটা নতুন ৬০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা ঘরোয়া রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে কংগ্রেসে আটকে আছে। আর ইউক্রেনের সমর্থকদের মধ্যে শঙ্কা ভর করেছে যে যদি নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও জিতে আসে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা থমকে যাবে।
এদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফেব্রুয়ারিতে নানা আলোচনা ও হাঙ্গেরির সাথে দর কষাকষির পর ৫৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবান, যিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠ, তিনি প্রকাশ্যেই ইউক্রেনকে সহায়তার বিরোধীতা করেন। এছাড়া ইইউ মার্চের মধ্যে যে মিলিয়ন আর্টিলারি সরবরাহ করতে চেয়েছে কিয়েভে সেটার অর্ধেক করতে সমর্থ হবে।
রাশিয়ার সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশি বেলারুশ, যাদের অঞ্চল ও আকাশপথ ব্যবহার করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বলছে, ইরান রাশিয়াকে শাহেদ ড্রোন সরবরাহ করছে। যদিও ইরান যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়াকে অল্প কিছু ড্রোন দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। মানুষবিহীন উড়ন্ত যান বা ইউএভি কার্যকরভাবে ইউক্রেনের বিভিন্ন লক্ষ্য আঘাত হানতে সমর্থ হয়েছে। আর এই যুদ্ধে আকাশ প্রতিরক্ষা ফাঁকি দিয়ে হামলার সামর্থ্য থাকায় দু’পক্ষ থেকেই ড্রোনের বেশ চাহিদা রয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে চেয়েছিলো, নিষেধাজ্ঞা সেভাবে কাজ করেনি। রাশিয়া এখনেও যেমন তেল বিক্রি করতে সমর্থ হচ্ছে, তেমনি তাদের সামরিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও অন্য দেশ থেকে আনতে পারছে।
চীন অবশ্য কোনও দেশকেই অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে না। তারা যুদ্ধ ঘিরে খুবই সতর্কভাবে তাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা রাশিয়াকে হামলার জন্য নিন্দাও করছে না, আবার মস্কোর সেনাবাহিনীকে সমর্থনও দিচ্ছে না – যদিও তারা এবং ভারত রাশিয়া থেকে নিয়মিত তেল কিনে চলেছে।
রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুই দেশই উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছেও ধর্না দিয়েছে সমর্থনের জন্য, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় প্রচুর কূটনৈতিক সফর করেছে তারা।
রাশিয়ার লক্ষ্য কি বদলে গিয়েছে?
এখনও বেশিরভাগের বিশ্বাস যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পুরো ইউক্রেন পেতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের টক শো উপস্থাপক টাকার কার্লসনের সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আবারও এখানকার ইতিহাস ও সংঘাতের ব্যাপারে তার বিতর্কিত মতামত তুলে ধরেন।
তিনি অনেকদিন ধরে কোনোরকম প্রমাণাদি ছাড়াই বলে আসছেন যে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে পূর্বে দনবাস অঞ্চলের মানুষদের রাশিয়ার নিরাপত্তার দরকার আছে। যুদ্ধের আগে তিনি একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে বলেন রাশিয়ান এবং ইউক্রেনিয়ান আসলে “একই জনগোষ্ঠী।”
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি বলেন যে তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ লক্ষ্য বদল হয়নি, এবং নানান অসমর্থিত সূত্রে যে দাবি করা হয় সেখানে চরম ডানপন্থীদের প্রভাব অনেক বেশি সেখান থেকে বের করে আনতে চান তিনি বা ‘নাৎসিমুক্ত’ করতে চান।
একইসাথে পুতিন বলেন ইউক্রেনকে তিনি চান ‘সামরিক বাহিনী বিলুপ্ত’ করে একটি ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে দেখতে, এবং একইসাথে নেটো যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে সেটার বিরোধীতা করেন তিনি।
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেন কখনোই কোন সামরিক জোটে ছিল না। তাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান এবং নেটোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনে যে আলোচনা চলছিল, এই দুটো বিষয়েরই সফলতা যুদ্ধ শুরুর পর এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এই লক্ষ্যগুলি ইউক্রেনকে রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী করবে এবং যেকোনও ভূরাজনৈতিক প্রকল্প, সেটা হতে পারে কোনভাবে আবারও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, তা থেকেও রক্ষা করবে।
যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে?
যেহেতু কোনও দেশই আত্মসমর্পণ করবে বলে মনে হয় না এবং পুতিনই আবার ক্ষমতায় থাকবেন বলে মনে হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের অনুমান এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবসেক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য ফলাফল পর্যালোচনা করেছে। সেটাতে সবচেয়ে বেশি যা উঠে এসেছে, তা হলো- ২০২৫ সালেরও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে, যাতে দু’পক্ষেরই প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটবে এবং ইউক্রেন মিত্রদের অস্ত্র সহায়তার উপর নির্ভর করে থাকবে।
আর দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফলাফল হলো- বিশ্বের অন্যান্য অংশেও সংঘাত বাড়বে, যেমন মধ্যপ্রাচ্য, চীন-তাইওয়ান এবং বলকানদের সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা ছড়াবে।
আরও যে দু’টি সম্ভাব্য ফলের কথা উঠে এসেছে, যেগুলোর সম্ভাবনা খুবই সামান্য, তার একটা হলো- ইউক্রেনে সামরিক দিক থেকে কিছুটা অগ্রসর হবে, কিন্তু যুদ্ধে শেষ করার মতো পরিস্থিতিতে যেতে পারবে না। অথবা, ইউক্রেনের মিত্রদের সমর্থন ফুরিয়ে আসবে এবং তারা একটা সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে।
তবে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কী হয় এবং একই সাথে অন্যান্য যুদ্ধ বিশেষত ইসরায়েল-হামাস সংঘাত কোনদিকে গড়ায় এবং সেটা ইউক্রেন ও রাশিয়ার মিত্রদের কীভাবে প্রভাবিত করে, সেসবের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
যুদ্ধ কি আরও ছড়াতে পারে?
এই ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে ‘কৃত্রিম অস্ত্র সংকটের’ মধ্যে ফেলে রাখলে তাতে লাভবান হবে রাশিয়া।
তিনি মিউনিখের এক নিরাপত্তা সম্মেলনে বলেন, যদি পশ্চিমা দেশগুলো তার পাশে না দাঁড়ায় তাহলে পুতিন আগামী কয়েক বছরে বিশ্বের আরও অনেক দেশের জন্যই ‘বিপর্যয়’ বয়ে নিয়ে আসবে।
দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বলছে, রাশিয়া খুব সফলভাবে তাদের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পে সাময়িক ধাক্কা সামলে তাদের সামরিক উৎপাদন বাড়িয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তারা বলছে যে ইউরোপ এটার সাথে তাল মেলাতে পারেনি, যে একই শঙ্কার কথা পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন।
ইউরোপিয়ান দেশের মধ্যে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এস্তোনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগ – তারাও সম্প্রতি শঙ্কা প্রকাশ করে জানায় আগামী দশকের মধ্যেই রাশিয়া কোনও নেটো রাষ্ট্রে হামলা করে বসতে পারে।
এই শঙ্কা নেটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে নতুন করে ভবিষ্যৎ ভাবনায় ফেলেছে, সেটা সামরিক সামর্থ্য এবং সমাজকে এক ভিন্ন রকম পৃথিবীতে বাস করার জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে।