প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে একক দেশ হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ থেকে প্রস্তাব তোলায় বাংলাদেশ ভোট দেয়নি। তবে দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ইউক্রেনের মানবাধিকার বিষয়ে হওয়ার কারণে ভোট দিয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধ তো একা একা হয় না। উস্কানি তো কেউ না কেউ দিচ্ছে। দিয়ে তো বাধালো যুদ্ধটা। তাহলে একটা দেশকে কনডেম (নিন্দা) করা হবে কেন? সেইজন্য আমরা ভোটদানে বিরত থেকেছি। গতকাল জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘে যখন প্রথম প্রস্তাবটি এলো আমরা দেখলাম সেই প্রস্তাবে মানবাধিকারের কথা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে রাশিয়ার অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেভেন ফ্লিট পাঠিয়ে যখন পাকিস্তানের পক্ষে রাশিয়া তখন আমাদের পক্ষে দাঁড়ালো। কাজেই দুঃসময়ে যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আমরা নিশ্চয়ই তাদের পাশে থাকবো। কিন্তু তারা যদি কোনো অন্যায় করে সেটা আমরা মানবো না। আর আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু যুদ্ধটা বাধালো কারা? সেটাও আমাদের দেখতে হবে। সেজন্য আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। যেহেতু একটি দেশের বিরুদ্ধে এজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ভোট দেবো না। দ্বিতীয় প্রস্তাবের প্রসঙ্গ টেনে সরকার প্রধান বলেন, ভোট দেয়ার এখন যে প্রস্তাবটা এসেছে এই যুদ্ধের ফলে, ইউক্রেনের মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে সবাই কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে মানবাধিকারের বিষয়টি ছিল। দ্বিতীয় প্রস্তাবে যেহেতু মানবাধিকার বিষয়টি রয়েছে সেজন্য আমরা ভোট দিয়েছি। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, যখন একটি দেশের বিরুদ্ধে প্রস্তাব, আমরা ভোট দেইনি। যখন মানবতার বিষয়টি সামনে আসলো আমরা ভোট দিয়েছি। আমার মনে হয়, এটা একেবারে স্পষ্ট।
রমজানেও পণ্যমূল্য সহনীয় থাকবে: প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পদক্ষেপে বাজারে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি আসন্ন পবিত্র রমজান মাসেও পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম লিখিত প্রশ্নে জানতে চান, বর্তমানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেই কারণে সাধারণ মানুষ চোখে অন্ধকার দেখছে। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার লক্ষ্যে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিনা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ সকল ধরনের পণ্যসামগ্রীর মূল্যের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও তা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। আসন্ন পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশের সকল সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নিম্নআয়ের এক কোটি পরিবারের নিকট রমজান শুরুর আগে ও রমজানের মাঝামাঝি মোট দুইবার টিসিবির পণ্যসামগ্রী ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে টিসিবির পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হবে।
তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় পূর্বের ন্যায় ট্রাক সেলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত সভা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সে অনুযায়ী প্রতিবেদন উপস্থাপনের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গঠিত দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল প্রতিদিন পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে। আমদানি ও সরবরাহ অবস্থা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এলসির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে। সকল জেলা ও উপজেলায় প্রতি মাসে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত টাস্কফোর্স কমিটি জেলা ও উপজেলা বাজারসমূহে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এ সকল মোবাইল কোর্ট পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী কর্তৃক ভোক্তাদের ওজনে কম না দেয়া, অধিক মুনাফার মানসিকতা পরিহার, দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের তালিকা টাঙানো, খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার রোধ ও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা রোধে জরিমানা করে থাকে। শেখ হাসিনা বলেন, পণ্যের মূল্য নিয়ে কেউ যেন মনোপলি বা অলিগোপলি অবস্থার সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সৃষ্টি করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনও কাজ করে যাচ্ছে। দেশীয় শিল্প-কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রাখাসহ উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ ও বিপণন স্বাভাবিক রাখতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। খাদ্যশস্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও ঊর্ধ্বগতি রোধের লক্ষ্যে চালকল পর্যায়ে ধান মজুতের সর্বোচ্চ পরিমাণ দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণের স্থলে ৩ গুণে হ্রাস করা হয়েছে।
পাইকারি বাজারগুলোতে মজুতদারি বন্ধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্যশস্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও ঊর্ধ্বগতি রোধের লক্ষ্যে চালকল পর্যায়ে ধান মজুতের সর্বোচ্চ পরিমাণ দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসেবে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণের স্থলে ৩ গুণে হ্রাস করা হয়েছে। পাইকারি বাজারগুলোতে মজুতদারি এবং বিভিন্ন রাইস মিলে অতিরিক্ত চাল মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যাতে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
সেইসঙ্গে ১০০টি বৃহৎ আকারের চালকলের মিলগেটের মূল্য নিয়মিত সংগ্রহ করে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিযান এবং কেউ অবৈধ মজুতের মাধ্যমে বাজারে যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ১০ টাকা দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে কর্মাভাবকালীন ৫ মাস (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ও মার্চ-এপ্রিল) সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে ৫০ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে মাসিক ৩০ কেজি করে চাল বিক্রয় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। ওএমএস কর্মসূচির আওতায় বিক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি করে বর্তমানে ২০১৩টি কেন্দ্রে ওএমএসের খাদ্যশস্য বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ওএমএস কর্মসূচি সমপ্রসারিত করে সকল পৌরসভায় পরিচালনা করা হচ্ছে।
একটি মহল দেশে অস্বাভাবিক সরকার চায়: এদিকে র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস কেন জানতে পারলো না, মুজিবুল হক চুন্নুর এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে সন্ত্রাস দমনে তখনকার বিএনপি সরকার র্যাব সৃষ্টি করেছিল। তবে, তারা র্যাবকে যথেচ্ছা ব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পর র্যাব জঙ্গি, সন্ত্রাস দমন, হত্যার তদন্তসহ মানবিক কাজই করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, তারা মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু মানুষের কাজ হচ্ছে দেশে যখন একটি অস্বাভাবিক সরকার থাকে অথবা অবৈধ দখলকারী কেউ যদি থাকে, তখন তারা খুব ভালো থাকেন। তাদের খুব গুরুত্ব থাকে। যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে তারা ভালো থাকে না। এজন্য তারা সব সময় তার (সরকারের) বিরুদ্ধে লেগেই থাকে। যতই ভালো কাজ করুক তারা পেছনে লেগেই থাকে কারণ তারা ভালো দেখতে চায় না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্য নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ?দুপুর ১২টায় তারা সরে গেল। আন্দোলন করে জনগণের সাড়া পেলো না কেন? আমি যদি সত্যি ভোট ছিনতাই করে নিতাম তাহলে তো ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সময়ে যেভাবে জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আন্দোলন করেছিল- দেড় মাসের মধ্যে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল সেভাবে আমাদের হটাতো! মানুষ তো সেভাবে সাড়া দেয়নি। কারণ মানুষ তো ভোট দিতে পেরেছে। একটি মহল দেশে অস্বাভাবিক সরকার চায় বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তারা সব সময়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের অভিযোগ, চিঠি, এই র্যাব সম্পর্কেও তাদের অভিযোগ।
এই অপপ্রচার তারাই করেছে। ওখানকার কংগ্রেসম্যান, সিনেটরের কাছে তথ্য পাঠানো, চিঠি দেয়া নানাভাবে তারা এই অপপ্রচার করে। সেখানকার আমাদের অ্যাম্বাসি সব সময় সক্রিয় ছিল। যখন এই ব্যাপার নিয়ে তারা আলোচনা করেছে তখন অ্যাম্বাসির কাউকে ঢুকতে দেয়নি। এটা আরও দুই বছর-তিন বছর আগের কথা। এর প্রক্রিয়া বহুদিন থেকেই চলছে। আমরা বার বার তাদের জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ এখানে র্যাবের কোনো সদস্য যখন অন্যায় করেছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। আপনারা জানেন, আমাদের একজন মন্ত্রীর জামাই একটি অপরাধ করেছিল। মন্ত্রীর জামাই হিসেবে কিন্তু আমরা ক্ষমা করিনি। তাকে ঠিকই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। শাস্তি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ কোনো সময় অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। সে যেই হোক। আইনশৃঙ্খলা সংস্থার যে কেউ কোনো অপরাধ করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই।