যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন। বাংলায় যাকে ‘চাঁচাছোলা’ ভাষা বলা হয়। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন ভেবেছিলেন ইউক্রেন দখল করতে পারলেই গোটা বিশ্ব হয়তো তার পায়ের তলায় আসবে। ভেবেছিলেন আমাদের দ্বিখণ্ডিত করবেন। কিন্তু উনি ভুল ভেবেছিলেন। কারণ আমরাও তৈরি। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কী কী মূল্য পুতিনকে চোকাতে হবে, তা রুশ প্রেসিডেন্ট এখনো কল্পনা করতে পারছেন না।
যে কারণে ব্যর্থতার দিকে রাশিয়া: প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানিয়েছন, গোটা বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিক ভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা তারা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে পঙ্গু করার পথে এগোচ্ছেন তারা। ব্রিটেন এবং কানাডা সরকারের দেখানো পথে হেঁটে রুশ বিমান সংস্থার সমস্ত বিমান আমেরিকান আকাশসীমায় ঢোকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বাইডেন প্রশাসন। ক্রেমলিন-ঘনিষ্ঠ রুশ ধনকুবেরদের ইয়ট থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন একাধিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও দিয়েছেন বাইডেন। সেই সঙ্গে ন্যাটো বাহিনী যে ইউক্রেনকে রসদ জুগিয়ে সমর্থন করছে, তার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাশিয়ার বৃহত্তম ব্যাংককে অর্থনীতি ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কতটা ছোট রুশ অর্থনীতি: সামরিক খাতে রাশিয়ার ভিত কিছুটা শক্ত হলেও অর্থনীতিতে বড় শক্তি নয়। রাশিয়ার অর্থনীতির আকার এখন ১ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার (১ হাজার বিলিয়নে ১ ট্রিলিয়ন)। তুলনা করলে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া (২ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার), টেক্সাস (১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন) এবং নিউ ইয়র্কের (১ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন) চেয়েও ছোট অর্থনীতি রাশিয়ার। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকারই ২০ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। মোট বৈশ্বিক উৎপাদনে রাশিয়ার অংশ এখন মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার ব্যাংকের ৮০ শতাংশ সম্পদের ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে এবং ইইউ এনেছে ৭০ শতাংশের ওপর। কেবল এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েই পশ্চিমারা ক্ষান্ত হবে না, যুদ্ধ খুব বেশি দীর্ঘস্হায়ী হলে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির এনার্জি, ইকোনমিক্স অ্যান্ড সিকিউরিটি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো এবং ডিরেক্টর এমিলি কিলক্রিজ। তার মতে, নিশ্চিতভাবে নিষেধাজ্ঞা এখনো কঠোর করার সুযোগ আছে। ইতিমধ্যে তেল শোধনের যন্ত্রাংশে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে রাশিয়ার চাপ সামলানোটা কঠিন হবে। আর ইউক্রেনে অভিযানের চাপ রাশিয়াকে বহুদিন ভোগাবে।
ঘরের মধ্যেও চাপে পুতিন: যুদ্ধ অবিলম্বে থামানোর আবেদন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সমস্ত রকম সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উত্পাদন সংস্থা লুকঅয়েল। বিশ্বের মোট উত্পাদিত অপরিশোধিত তেলের প্রায় ২ শতাংশ উত্পাদন করে এই রুশ সংস্থা। প্রায় ১ লাখ কর্মী কাজ করেন এই সংস্থায়। ইউক্রেনে রুশ সেনা অভিযানের বিরোধিতা করে লাইভ সম্প্রচার চলাকালীনই টিভি রেইন চ্যানেলের সমস্ত কাজকর্ম বাতিল করে দেওয়ার পরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন কর্মীরা।
রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে প্রতিদিনই বিক্ষোভ চলছে। বিপরীতে চলছে ধরপাকড়। অনেকেরই আশঙ্কা যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশটিতে সংকট আরো তীব্র হবে এবং বাড়বে জনঅন্তোষ। কিয়েভভিত্তিক ইস্ট ইউরোপীয়ান ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের চেয়ারপার্সন ড. মৃদুলা ঘোষ বলছেন, প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। এটা কমাতে হয়তো সামরিক শাসন জারি করতে পারেন। এটি হলে মানবাধিকারকে সংকুচিত করার সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু ধরুন মানুষ কথা বলল না, কিন্তু মানুষের পকেটে যখন টান পড়বে সেটা কীভাবে সামলানো হবে তা বলা মুশকিল। অদূর ভবিষ্যতে দুদিক থেকে গণ-অসন্তোষের বড় ঢেউ এলে, সেটা চাপা দেওয়া যাবে না।
গত পহেলা মার্চ দ্য মস্কো টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে রাশিয়া এবং ইউরেশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ও বেলারুশে সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত নাইজেল গোল্ড-ডেভিস লিখেছেন, প্রথমত: পুতিন ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতাকে খুবই দুর্বল ভেবেছিলেন। দ্বিতীয়ত: পশ্চিমারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এতটা কড়া পদক্ষেপ নেবেন তা ভাবতে পারেননি এবং তৃতীয়ত: পুতিন নিজ দেশের ভেতর এতটা বিক্ষোভের মুখোমুখি হবেন তা কল্পনাও করেননি। ফলে পুতিনের এসব আগেভাগেই চিন্তা না করার কারণে সংঘাত আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকরাও যুদ্ধে নেমেছেন। প্রবাসীরাও দেশে ফিরেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। এমনকি বিদেশি অনেক স্বেচ্ছাসেবীও ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই করতে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছেন। আবার ইউক্রেনের সেনারা পুরোনো সব যুদ্ধের কৌশল বেছে নিয়েছে যাতে রুশ সৈন্যরা ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়ছে।