দেশে এবং বিদেশে গার্মেন্টস সেক্টরের অন্যতম রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ বছর হলেও এ ঘটনায় নিহত এবং আহত শ্রমিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় কোনো সুরক্ষা নীতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) অন্যতম শীর্ষ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন। শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ বছর পূর্তিতে তিনি বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ বছরে পার করতে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরেও আমাদের প্রথম বছরের দাবি দাওয়াগুলোই আবারও নতুন করে উত্থাপন করতে হচ্ছে। আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের শ্রমিকের নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রের শ্রমিক নিহত হলে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, আহত হলে সেই শ্রমিকের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং পুনরায় কাজে ফেরার নিশ্চয়তা, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, যে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না থাকায় সেদিন ভবনে ফাটল থাকা সত্ত্বেও শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছিল কাজ করতে।
এ শ্রমিক নেতা আরও বলেন, শ্রম আইনের শাস্তির চেয়ে দুর্বল ধারা, একইসঙ্গে আইনের যে দুর্বল গতি যে কারণে এখনও রানা প্লাজা ঘটনার বিচার শেষ হয়নি। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির অষ্টম বছর পরেও এই দাবিগুলিই আমরা নতুন করে উত্থাপন করছি। তিনি আরো বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন এখনো সম্প্রসারণ হওয়ার পরিবর্তে আরো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আমাদের শ্রম আইনে কোনো শ্রমিক যদি কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা। আমরা এত উন্নত হয়েছি, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। সেই দেশে একজন শ্রমিকের মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা, এটা একজন শ্রমিকের জীবনের সঙ্গে উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই না।
করোনা মহামারি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান করোনাকালীন শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তার পরেও রাষ্ট্র এবং মালিক কারো কাছ থেকেই তারা তাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকুও পাচ্ছে না। এখনো আমাদের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মুজুরিতেই কাজ করতে হয়। এখন পর্যন্ত ২১৮টি ভবনধস, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এসবের কোনোটাতেই মালিকের কোনো শাস্তি হতে আমরা দেখিনি। ফলে দুর্বল শাস্তি অনেক সময় আইনকে পরোয়া না করার পরিস্থিতি তৈরি করে।
ফলে রানা প্লাজার ঘটনায় আমরা বলব, আহত অনেক শ্রমিক এখনো তাদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। রানা প্লাজায় কাজ করা শ্রমিকদের একটি বড় অংশ আর কাজে ফিরতে পারেনি। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ফলে তাদের শারীরিক অক্ষমতা এবং মানসিক ভীতি থেকে তারা এখনো মুক্তি পায়নি। যারা কাজ করতে এসে দুর্ঘটনায় পড়ে, পঙ্গু হয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো সুরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হয়নি। এজন্য আমরা একটা দাবি করেছিলাম, সোশ্যাল সিকিউরিটি ইন্স্যুরেন্স করার। এর ফলে ছোট কিংবা বড় যে কোনো কারখানায় যে কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় নিহত হলে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহত হলে তার চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। সেটার দায়িত্ব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষ থেকে করা যেত। সেটাও এখন পর্যন্ত করা হয়নি।
শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের এ নেতা আরো বলেন, আমরা মনে করি একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য টাকা দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। কিন্তু কর্মক্ষম একজন শ্রমিকের মৃত্যুর ফলে তার পরিবারটি যেভাবে অসহায় হয়ে পড়ে, সেই অসহায় পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ক্ষতিপূরণের প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, ক্ষতিপূরণ আরো একটি কারণে প্রয়োজন, মালিকদের অবহেলা এবং আইন অবজ্ঞা করার কারণে শ্রমিকদের জীবনের যে ক্ষতি হয়, মালিকেরা যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নামে অন্তত অর্থদণ্ড ভোগ করে, তাহলেও তারা একটু সতর্ক হবেন। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে দায় তার কোনোটাই এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি। রানা প্লাজার ৮ম বর্ষ পূর্তিতে আমরা এই দাবিগুলি পুনরায় করবো। জীবিকার জন্য যেন শ্রমিকদের জীবন হারাতে না হয়। যে শ্রমিক সংসারের চাকা এবং দেশের উৎপাদন বাড়াতে কাজের জন্য কর্মক্ষেত্রে আসে, সে যেন কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে সমাজ এবং সংসারের কাছে বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
রাজেকুজ্জামান রতন রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, জুরাইন কবরস্থানে গেলে সেখানে এখনো অনেক অচিহ্নিত শ্রমিকের কবর দেখা যায়। শ্রমিকদের নিয়োগ এবং পরিচয়পত্র থাকলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তারা অন্তত অচিহ্নিত থাকত না। ফলে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগপত্র এবং পরিচয়পত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা। রানা প্লাজা এবং তাজরীনে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের জন্য জুরাইন কবরস্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা, যেন এই স্মৃতিস্তম্ভ আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় যে- আমাদের জীবনকে নিরাপদ করতে একদল মানুষ তাদের জীবন দিয়েছিল। রাষ্ট্র এবং সমাজ তার দায়িত্ব নিয়েছিল বা নেইনি সেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়েও যেন এই স্মৃতিস্তম্ভটা দাঁড়িয়ে থাকে। একইসঙ্গে রানা প্লাজার ওই জায়গায় আমরা শ্রমিক কলোনি বানিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলাম। ৮ম বছর পূর্তিতে আমরা এই দুটো দাবিও আবারও নতুন করে করছি।