ঢাকার উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বেহাত হওয়া ২৪টি প্লট উদ্ধারে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। দখলদাররা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। ফলে তাদের প্রভাবের মুখে থেমে যায় উচ্ছেদের সব তৎপরতা। হাতছাড়া হওয়া সরকারি এই প্লটগুলোর বাজার মূল্য অন্তত ৪৫০ কোটি টাকা।
রাজউক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্লট দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘উচ্ছেদ করলে ফের দখল হয়ে যায়। তাই এ সপ্তাহের মধ্যেই আমরা নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করব। নিলামে অংশ নিয়ে যারা প্লট পাবেন দখলমুক্ত করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এ সপ্তাহেই পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে। দখলদাররা যত প্রভাবশালী হোক তাদের এবার উচ্ছেদ করা হবেই। দখল প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজউক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজউকের অধীনে উত্তরা দ্বিতীয় প্রকল্পের আসাসিক প্লটগুলোর বরাদ্দ শেষ হয় ২০০৫ সালে। এরপর ১৭ বছর পার হলেও সংস্থাটি সব বাণিজ্যিক প্লট নিলাম করে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা করতে পারেনি। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী উত্তরা দ্বিতীয় প্রকল্পের বাণিজ্যিক প্লটের প্রতি কাঠার দাম অন্তত ৩ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২৪টি প্লটের মোট জায়গার পরিমাণ ১৫০ কাঠা। এ হিসাবে দখল হয়ে যাওয়া প্লটগুলোর দাম প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। দখল হওয়া প্লটগুলো ১০ ও ৫ কাঠা আয়তনের। রাজউকের অবহেলার কারণে দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালীরা অন্তত ২৪টি প্লট দখল করে নিয়েছে। সেখানে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে রীতিমতো স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রাজউকের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খোদ সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই এ ধরনের প্লটগুলো উচ্ছেদ প্রক্রিয়া এখন কিছুটা জটিল হয়ে গেছে। কারণ দখল হওয়া অনেক প্লট নিয়ে মামলা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। উচ্ছেদ করতে গেলেই দখলবাজরা জাল কাগজপত্র দেখিয়ে প্লটের মালিকানা দাবি করে আদালতে যায়। তবে রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো সময় দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্লটগুলো নিলামে বিক্রি করে বিপুল টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করা সম্ভব। এজন্য শুধু সরকারের ওপর মহলের সদিচ্ছা ও কঠোর নির্দেশনা দরকার।
জানা গেছে, ওই এলাকায় রাজউকের ৬০টি বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি প্লট এখনো বরাদ্দ হয়নি। বরাদ্দ না হওয়া প্লটগুলো নিয়ে ১৭টি মামলা চলছে। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা গেছে, রাজউকের বরাদ্দ না হওয়া যে ২৪টি প্লটে অবৈধভাবে দোকান গড়ে তোলা হয়েছে, তার মধ্যে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে পড়েছে ৮টি প্লট। ১২টি আছে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে। বাকিগুলো ৯ ও ১৪ নম্বর সেক্টরে পড়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্লটগুলোর বেশিরভাগের দখল নিয়েছেন ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুর রহমান। রীতিমতো স্ট্যাম্পে করা চুক্তিপত্রে সই করে তিনি দোকান ভাড়া দিয়েছেন। প্লটগুলোতে অবৈধভাবে আসবাবপত্র, লেপ-তোশক, রেন্ট-এ-কার ও খাবার হোটেল গড়ে তোলা হয়েছে। চুক্তিপত্রের কপি ফাঁস হয়ে গেলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শরীফুর রহমান নিজের ইমেজ রক্ষায় প্লট উদ্ধারে রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর দুদফা চিঠিও লেখেন।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আবেদন জানানো হয়েছিল। অদ্যাবধি ওই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। অবৈধ স্থাপনার ফলে যানজট সৃষ্টি, নিরাপত্তা বিঘ্নিত, আবাসিক পরিবেশ নষ্ট ও জনসাধারণের চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। জনমনে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্লটগুলো রাজউকের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।’
জানতে চাইলে প্লট দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো প্লট দখল করিনি। আমার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না। উলটো আমি রাজউককে একাধিক চিঠি দিয়ে প্লটগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। রাজউক তাদের প্লট দখলমুক্ত না করলে আমার কী করার আছে। যারা প্লটগুলো দখল করেছে তারা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্লট দখলের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই।’ চুক্তিপত্রে সই করার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
পুলিশ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৩ নম্বর সেক্টরের ৬৩ ও ৮১ নম্বর প্লটটি দখলে নিয়ে দোকান বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন উত্তরা পশ্চিম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিলুজ্জামান বিপুল। ৭৯ নম্বর প্লটের দোকান বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগ কর্মী জজ মিয়া। প্রভাবশালী একজন জনপ্রতিনিধির ভাগ্নে কবির হাসানের দখলে আছে ৫৭, ৭১, ৭৩ ও ৭৫ নম্বর প্লট। ৬৫ নম্বর প্লট দখল করে দোকান বাণিজ্য পরিচালনা করছেন কিশোর গ্যাং সদস্য জিদান, সাজ্জাদ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা হযরত আলী। ৫৯ ও ৬১ নম্বর প্লটের দখলদার ওমর ফারুক। ৪৯ ও ৪৭ নম্বর প্লট দখলে নিয়ে স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন ১ নম্বর ওয়ার্ড (পশ্চিম) যুবলীগ সভাপতি সোহেল। ৪৫ নম্বর প্লট নিয়ন্ত্রণ করেন জনৈক জহির আর ৪৩ নম্বর প্লট দখলে আছে যুবলীগ নেতা আবুল কালাম রিপন। ২৯ ও ৫৪ নম্বর প্লটের দখলদার যুবলীগ নেতা ইফতেখার জুয়েল। ৮২ ও ৮৪ নম্বর প্লট নাজমুল, ৫০ ও ৮০ নম্বর প্লট শ্রমিক লীগ নেতা ইউনুসের দখলে। এছাড়া ৪৪ নম্বর প্লট দখলে নিয়ে কাঁচাবাজার তৈরি করেছেন কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা শফিকের শ্যালক জনি। ৯ নম্বর সেক্টরের ২/১ নম্বর প্লটের দখলদার সালাউদ্দিন ও নূরুল আমিন নুরু। ১৪ নম্বর সেক্টরের ২২ নম্বর প্লটে সোহেল ও নূরুল আমিন নূরু মিলে অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, মাঝারি ও বড় দোকানের মাসিক ভাড়া ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ছোট আকারের কিছু দোকানের ভাড়া ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। ভাড়ার বাইরে দোকান পেতে এককালীন অগ্রিম টাকাও দিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। টাকা নেওয়ার সময় স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিপত্র করাও হয়েছে। প্রতিটি প্লটে তৈরি করা অবৈধ স্থাপনা থেকে দিনে ২-৩ লাখ টাকা করে ভাড়া তোলা হয়। মাসে তোলা হয় কমবেশি ৫০ লাখ টাকা। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ছয় কোটি। এই টাকার ভাগ পৌঁছে যায় বিভিন্ন মহলে।
দখলের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ৫৯ ও ৬১ নম্বর প্লটের দখলদার ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা কোনো প্লট দখল করিনি। রাজউকের প্লট খালি পড়ে আছে, তাই আমরা দোকানপাট তুলে ব্যবসা করছি। রাজউক যখন চাইবে আমরা তখনই প্লট ছেড়ে দেব। আমি একটা দোকান তুলে নিজেই ব্যবসা করছি। এটাকে দখল বলা যায় না।’
দখলের কথা স্বীকার করে আওয়ামী লীগ কর্মী জজ মিয়া বলেন, ‘আমি একা নয়, আমার মতো আরও ১৫ জন আছে। আমি একটা প্লট নিয়ে আছি। কেউ কেউ একাধিক প্লট নিয়ে আছে। আমার প্লটে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা ওঠে। কাঁচাবাজারে খবর নেন ওখান থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা ওঠে। ওইদিকে ভালো করে খবর নেন। রিপোর্ট করলে সুন্দর করে সবার নাম দিয়ে করবেন। আমি যেমন ভাড়া পাই, তেমনি আমাকেও কারও কাছ থেকে ভাড়া নিতে হয়েছে।’ কার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন-এমন প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি। তার দলীয় পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী।’ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ছাত্রলীগ নেতা শাকিলুজ্জামান বিপুল, কবির হাসান, যুবলীগ নেতা সোহেলসহ বেশ কয়েকজনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযানে রাজউকের এসব প্লট বেহাতের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিযানের পর দুদক কর্মকর্তারা কমিশন বরাবর প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দখলদারদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের একজন সহকারী পরিচালক ও একজন উপসহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে ওই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। দুদক তথ্য পেয়েছে, প্লটগুলো দখলমুক্ত করতে রাজউক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।