শিক্ষার্থীদের দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য দরকার যোগ্যতা (জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ) সমৃদ্ধ শিক্ষক। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। এনটিআরসিএ-র নীতিমালায় ছিল—শিক্ষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের যোগ্য বিবেচিত হবে না। সুতরাং শিক্ষার্থীদের পথ পদর্শক হবেন যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিবন্ধিত শিক্ষক। স্নাতক-মাস্টার্স করা তরুণ-তরুণীরা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে ‘নিবন্ধন সনদ’ অর্জন করেছে এবং শিক্ষক হিসেবে শুধু তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হবে। কাজেই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কাজটা স্বচ্ছ এবং সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু যুগোপযোগী শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এনটিআরসিএ-র অব্যবস্থাপনায় এখন প্রশ্নবিদ্ধ। চরম বৈষম্য ছাড়া শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেন না, না খেয়ে থাকলেও মুখ খোলেন না। যারা যৌক্তিক দাবিকে অবজ্ঞা করে শিক্ষকদের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা একাংশের আবদার বলে চালিয়ে দিতে চান, তারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ ভুলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের বৈষম্য থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশে যৌক্তিক দাবি নিয়ে শিক্ষকদের কেন সাতমাস রাস্তায় থাকতে হলো, কে দেবে এর জবাব?
এনটিআরসিএ-র বেশির ভাগ নিবন্ধিত শিক্ষকই সরকারি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ এবং নতুন কারিকুলামে কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে প্রত্যেকেরই আছে পিডিএস আইডি। এছাড়াও নিবন্ধিত শিক্ষক, শিক্ষকতা পেশাকে ব্রত হিসেবে নিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্নাতক-মাস্টার্স, এমনকি এমএড-বিএড করেও নামেমাত্র পারিশ্রমিকে (প্রতিষ্ঠানের শাখা অনুমোদন না থাকায়) হচ্ছেন বৈষম্যের শিকার। এইসব নিবন্ধিত শিক্ষকদের স্ব-স্ব নীতিমালায় নিয়োগ দিলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং লাভবান হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত থাকছে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এবং এইচএসসি লেভেলে থাকছে গ্রুপভিত্তিক পড়াশোনার সুযোগ। সুতরাং এইচএসসি লেভেলে প্রত্যেকটি কলেজে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখা থাকবে বাধ্যতামূলক। ফলে নতুন করে কলেজে নিয়োগ হবে অনেক নিবন্ধনধারীর। যাদের স্কুল ও কলেজ উভয় নিবন্ধন আছে, তাদের অনেকেই সুযোগ নেবে কলেজ নিবন্ধনের বিপরীতে চাকরির। ফলে এখন যে কৃত্রিম শিক্ষক সংকট আছে তা আরো তীব্র হবে। অথচ এনটিআরসিএ গণবিজ্ঞপ্তিতে যাদের সুপারিশ করছে তাদের বেশির ভাগ চাকরিপ্রত্যাশী নয়, বদলিপ্রত্যাশী (বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলির সিষ্টেম চালু না থাকায় একাধিক অর্জিত সনদের সাহায্যে তারা সুপারিশের সুযোগ গ্রহণ করে), ফলে শূন্য পদ শূন্যই থাকে। যারা বদলিপ্রত্যাশী তাদের মিউচুয়াল ট্রান্সফার বা বদলি ব্যবস্থা হলে প্যানেল প্রত্যাশীদের কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। যারা ইতিমধ্যে সুপারিশ পেয়েছেন, তাদেরও দুঃখ-কষ্টের কাহিনি আছে। মিউচুয়াল ট্রান্সফার বা বদলি ব্যবস্থা হলে তাদের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে। হয়তো নিজ জেলা বা উপজেলায় একটু ভালো থাকবেন। যারা যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যোগ্য শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছেন না, ব্যর্থতা তো তাদের, ক্ষতি তো তারা করছেন। যারা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না পেয়ে পদ ফাঁকা রাখছেন, কিন্তু পত্র-পত্রিকায় সাক্ষাত্কারের সময় বলছেন যোগ্য শিক্ষক পাইনি। যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অপমানবোধ হয়। আর হবেই বা না কেন—যোগ্যতার পরিমাপ এখন নিছক নম্বর যা পূর্ব নির্ধারিত নয়। ১-১২তমদের (গেজেটে নম্বরভিত্তিক এগিয়ে থাকার কোনো পূর্বাভাস না থাকায়) নব্বই ভাগের অবস্থানই তালিকার শেষাংশে। এনটিআরসিএ-র নিবন্ধিত শিক্ষকদের চাওয়া সরকারের সদিচ্ছার পরিপন্থি নয়। শূন্য পদের বিপরীতে সরকারের বাজেট থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক শূন্যতায় ভুগছে। এনটিআরসিএ-র ২৫%-এরও কম সুপারিশ দক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নিবন্ধিতরা যাবেন কার কাছে? বছরে প্রতি পরীক্ষায় ২০/৩০ হাজার যোগ হবে আর নিয়োগ হবে ১০/১২ হাজার, বাকিরা কেন অযোগ্য হবেন?
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতেও কাটছে না কৃত্রিম শিক্ষক সংকট। এনটিআরসিএ এতদিন পর এসে এখন বলছেন, খালি থাকা পদগুলোর জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রার্থী নেই। যে বিষয়ে এরকম সমস্যা সে বিষয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক ঘাটতি পূরণ করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেন যোগ্য প্রার্থীর তালিকা থাকা সত্ত্বেও বছরে একবার (দুইবার গেজেট পরিপন্থি) পরীক্ষা নিয়ে প্রতিবার একটু একটু করে সকল বিষয়ের প্রার্থীদের তালিকার পিছন দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে বেশকিছু বিষয়ে ৪০ নম্বরেও সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ১৫ হাজার পদে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। বলা হয়েছিল কোনো আবেদন পড়েনি, কিন্তু আবেদনকারীর তথ্য উপস্থাপন করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিবন্ধিত শিক্ষকের মধ্যে এত বৈষম্য, এত বিভেদ, এত পার্থক্য—এর আসল উদ্দেশ্য কী?