২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার পর তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। এক পর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম।
পুলিশ ভেবেছিল জঙ্গি হামলা
জঙ্গিবিরোধী একাধিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। সফল জঙ্গিবিরোধী অভিযানের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন তিনি। মামলায়ও তিনি স্ত্রী হত্যার পেছনে জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাই শুরুতে এটাকে জঙ্গি হামলা হিসেবে সন্দেহ করেছিল পুলিশ। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েকজনকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অন্য দিকে মোড় নেয় তদন্ত। হত্যা মামলায় ওই বছরের ৮ ও ১১ জুন নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারী উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্না থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এরপর ২৬ জুন মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা জানান, মিতুকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি ভোলা নামে একজন তাদের দিয়েছিল। এরপর এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে ৩২ বোরের একটি পিস্তলসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের দাবি ছিল, ওই অস্ত্র ব্যবহার করেই মিতুকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে পুলিশের পক্ষ থেকে ভোলা ও মনিরকে আসামি করে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ওই বছরের ১ জুলাই মোটরসাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিতু হত্যায় তাদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। ভোলা, সাইদুল ও রবিন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদ ও পদত্যাগ
জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ২০১৬ সালেল ২৪ জুন গভীর রাতে খিলগাঁও ভূঁইয়াপাড়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আবার তাকে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওইদিনই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি জানাজানি হলে মিতু হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যদিও ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন বাবুল আক্তার। কিন্তু সেই আবেদনে সাড়া দেননি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এরপর থেকেই তার পদত্যাগের গুঞ্জন ওঠে।
অবশেষে ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।ওই সময় পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। যদিও বাবুল আক্তারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।
২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বাবুল আক্তারের পদত্যাগের বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন। ওইদিন তিনি বলেছিলেন, ‘বাবুল আক্তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আমরা তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর আমরা দেড় মাস অপেক্ষা করেছিলাম। তিনি এটা প্রত্যাহার করেন কি-না। তবে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ পদত্যাগ নিয়েও গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়।
ভোল পাল্টান মিতুর বাবা
এদিকে হত্যাকাণ্ডের বছরখানেক পর মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনা ও নির্দেশে তার মেয়েকে খুন করা হয়েছে। যদিও মিতু হত্যার পর তিনিই বাবুল আক্তার সম্পর্কে গণমাধ্যমে নানা ইতিবাচক কথা বলেছিলেন।
তার এ দাবির বিপরীতে পুলিশের তরফ থেকে কখনোই মিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। এমনকি গোয়েন্দা বিভাগও মাত্র দুবার বাদী বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বাদীর দিক থেকেও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে কোনো তাগাদা ছিল না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় নাকি তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনা সত্যি হলে কোনোভাবেই সেটা ন্যায়বিচার হতে পারে না। আমার মেয়ের খুনিকে কেউ কিছুর বিনিময়ে ছেড়ে দিতে পারে না। জড়িত না থাকলে বাবুল চাকরি ছাড়লেন কেন? আর মুছা কেন তার মেয়েকে খুন করবেন? মুছা যদি খুন করে থাকেন, সেটা বাবুলের কারণেই করেছেন। এক বছরেও পুলিশ মুছার হদিস বের করতে না পারায় হতাশ তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদ ও গ্রেফতার নিয়ে ধুম্রজাল
মিতু হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে বাবুল আক্তারকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার পর থেকে। মঙ্গলবার (১১ মে) সন্ধ্যায় পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেছিলেন, বাবুল আক্তার মামলার বাদী। তিনি নিজেই চট্টগ্রাম এসেছেন। মামলার তদন্তের বিষয়ে বাবুল আক্তারের সঙ্গে জুরি ডিসকাশন চলছে। আজ সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তার সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে। রাত ৮টার দিকে বাবুল আক্তারকে গ্রেফতারের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
পরে পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র রাত ১০টার দিকে জানায়, স্ত্রী হত্যা মামলায় তার (বাবুল আক্তারের) সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এ কারণে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতে তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হবে। সেই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বুধবার সকালে আদালতে তোলা হবে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।