মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে আজ সোমবার (৪ এপ্রিল) ওয়াশিংটনে বৈঠকে বসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। জো বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটিই সশরীরে দ্বিপাক্ষিক প্রথম বৈঠক হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির দিনে এ বৈঠকে র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার কথা জানিয়েছেন মোমেন। আবারও বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়টিও বৈঠকে তোলার কথা বলেছেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল গত শনিবার (২ এপ্রিল) রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে গতকাল রোববার (৩ এপ্রিল) সকালে ওয়াশিংটন পৌঁছেন। আইএডি বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ
যাওয়ার আগের দিন ঢাকায় তার বাসায় র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি বৈঠকে তোলার কথা জানিয়ে মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা আমরা তুলব। তারা নিশ্চয় বলবে যে, এটাতে প্রসেস আছে, অমুক আছে। আমরা তাদেরকে বোঝাব, এ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আমাদের দেশে সন্ত্রাস কমেছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, আমাদের আশেপাশের দেশেও সন্ত্রাসটা অনেক কমে গেছে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য।’ র্যাব মোটামুটিভাবে ‘দুর্নীতিপরায়ন না’- এ বক্তব্যও বৈঠকে তুলে ধরার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিপরায়ন হলে অনেক দাগি দাগি লোক পার পেয়ে যেত। সুতরাং তোমাদের এদেরকে অনার করা উচিত। সুতরাং তোমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমরা বুঝলাম তাদের একটু সমস্যা হয়েছে, তবে তাদের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত।’
বিনিয়োগ প্রসঙ্গ
বৈঠকে বিনিয়োগের বিষয়ও তুলবেন উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগকারী একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম, যার বেশির ভাগ জ্বালানি খাতে। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, সমুদ্র অর্থনীতি, নিরাপদ খাদ্যের মত সম্ভাবনাময় শিল্প ও সেবা খাতে দেশটির বিনিয়োগ চাওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের মাধ্যমে দেশটির বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৭টি হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের তথ্য পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিও আমরা ডাইভারসিফিকেশন করতে চাই। এমন বার্তা আমি ওদেরকে দেবো। জলবায়ু পরিবর্তনও বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় বিষয় মন্তব্য করে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক বড় কাজ করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন তিনি। মোমেন-ব্লিংকেন বৈঠকের দুদিন পর দুদেশের মধ্যে ‘নিরাপত্তা সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হবে।
সামরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে জিসোমিয়া এবং অ্যাকুইজিশন ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট (আকসা) করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। দুপক্ষের মধ্যে আদান-প্রদান করা সামরিক তথ্যের সুরক্ষা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা বজায় রাখতে করা হয়েছে জিসোমিয়া বা জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট। বাংলাদেশের কাছে এ চুক্তির একটি খসড়া দিয়ে গেছেন সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
সরকার এ খসড়া পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘যারা সিকিউরিটি ডায়ালগে যাবে, তারা এটা পরীক্ষানিরীক্ষা করবে। আমরা তো ঝাঁপ দিয়ে পড়ব না। আর আমরা চাপের মুখে কিছু করি না। আমাদের এটা খুব সৌভাগ্য, আমরা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনাকে পেয়েছি যিনি চাপের মুখে কিছু করেন না।’ অস্ত্রের চেয়ে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রযুক্তি প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা কার সাথে যুদ্ধ করব? আমরা তো অস্ত্রের ভাণ্ডার সৃষ্টি করতে চাই না। কারণ আমাদের প্রয়োজন নাই। আমরা খুব শান্তিপ্রিয় দেশ। সকল প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সুসম্পর্ক।’
‘অস্ত্র সংগ্রহ করলে তো যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব আসে। আমরা ওগুলোতে নাই। অন্য ধরনের ব্যবসা তো তোমরা করতে পার। তোমরা টেকনোলজি দাও। আমরা এটা নিয়ে কাজ করতে চাই। অস্ত্র আমাদের খুব কম প্রয়োজন। আমাদের যেগুলো প্রয়োজন, সেগুলো নিশ্চয়ই আমরা বিবেচনা করব।’ যুক্তরাষ্ট্র্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে তারা আমাদেরকে কখনও অনুরোধ করে নাই। ইন্দো-প্যাসিফিক একটা ফিলোসফি। এই ফিলোসফি আমাদের সাথে মোটামুটি এক। আমাদের কোনো তফাৎ নেই। তারা বলছে, এটা অবাধ, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও উন্মুক্ত হবে। কোনো একটা দেশ বাধাগ্রস্ত করুক তারা এটা চায় না। আমরাও চাই না। এক্ষেত্রে আমরা এক।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে, তাদের ভয় যেটা হলো, চায়না হয়ত এখানে বেশ মাতব্বরি করবে। ফ্রি, ইনক্লুসিভ হবে আর নেভিগেশন হবে সবার জন্য বাধাহীন, সেক্ষেত্রে আমরা দ্বিমত পোষণ করি না। তবে, আমরা কারও লেজুড় হতে চাই না। বা আমরা চাই না এই ইন্দো-প্যাসিফিকটা বাধাগ্রস্ত হোক। এটা রাজনীতির চেইজবোর্ড হোক, আমরা চাই না।’
রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর প্রসঙ্গ
বঙ্গবন্ধুর সাজাপ্রাপ্ত খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে বৈঠকে তোলার কথা জানিয়ে মোমেন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করতেছি। এ ব্যাপারে আমরা সজাগ। এবারও আমাদের আলোচনায় তুলব। আমরা ভালো শাসন চাই, আইনের দেশ আমরা, কিন্তু একজন খুনী তোমাদের এখানে মিথ্যা তথ্য দিয়ে টিকে আছে। এটা আমরা সবসময় তুলি।’ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমদসহ বাহিনীর ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ১৫ ডিসেম্বর ব্লিংকেনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ হয় মোমেনের। এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে উভয়ের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। সে সময় টেলিফোনে আলাপ সারেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সফরে আরও যা থাকছে
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়াও সফরকালে মোমেন ইউএসএআইডি এর প্রশাসক, কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের বৈঠক এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ৭ এপ্রিল ফ্লোরিডার মায়ামিতে বাংলাদেশ কন্সুলেট জেনারেলের চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়া বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কয়েকটি সেমিনারেও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।